Arambagh Times
কাউকে ছাড়ে না

তনুশ্রী ভট্টাচার্য : স্কুল বিল্ডিং এর মিড ডে মিলের রান্নাঘর। কয়েকজন রাঁধুনী। প্রায় সকলেই মধ্যবয়স্কা। তাদেরই মধ্যে একজন মা আছেন যাঁর মেয়ে ওই স্কুলেরই সপ্তম শ্রেণীর পড়ুয়া। মাঝেমাঝেই দেখা যায় মেয়েটি শ্লেট হাতে নিয়ে এক ছুটে মায়ের কাছে চলে যাচ্ছে। আবার কিছু পরে মা পা টিপে টিপে সপ্তম শ্রেণীর ক্লাসের দোরগোড়ায় পৌঁছে যাচ্ছে। ইশারায় ডাকছে মেয়েকে। মেয়ে শ্লেটে নজরদারি চালিয়ে কিছু ভুল শুধরে দিচ্ছে। মা ফিরে যায় রান্না ঘরে।ব্যস্ত হয় মিড ডে মিলের রান্নায়। । মেয়ে ঢোকে ক্লাস রুমে ।জীবন বিজ্ঞানের দিদিমণি এসে গেছেন।
বেশ কিছুদিন এটা লক্ষ্য করার পর বোঝা গেল ওই রাধুনী মায়ের পড়াশোনা চলছে। খুব চুপি চুপি,সন্তর্পণে। এখন মা নিজের নাম, গ্রামের নাম লিখতে পারে, সরস্বতী পুজোর বর্ণনা, চাঁদ আর সূর্যের রচনাও লিখতে শিখেছে। পড়তে পারে মেয়ের বাংলা বই খানি। সর্বশিক্ষা বা সাক্ষরতা অভিযান যে কাজ করতে পারেনি ওই সপ্তম শ্রেণীর মেয়ে মায়ের জন্য তাই করে ফেলল ।অবশ্য তারা কেউই জানে না যে সাক্ষরতার জন্য আস্ত একটি দিন ইউনেস্কো থেকে ঘোষণা করা হয়েছে আন্তর্জাতিক স্তরে। ১৯৬৬ সাল থেকে যা এখনো চলে আসছে। আজ সেই আটই সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস।
সমাজের খেটে খাওয়া ,পিছিয়ে পড়া ,অশিক্ষার আঁধারে ডুবে যাওয়া মানুষদের সাক্ষর হওয়াটা যে ভীষণ জরুরী এবং সেই অনুযায়ী পদক্ষেপ গ্রহণ করা, লক্ষ্য স্থির করা, অভিমুখীকরণ কর্মসূচির মাধ্যমে সেই নিরক্ষর মানুষগুলোর একেবারে উঠোনে ,ঘরের দাওয়ায় পৌঁছানো যে এই মুহূর্তে খুব দরকার তা বোঝাবার জন্যই এই দিনটি পালন করা প্রয়োজন। যেহেতু লিখতে ও পড়তে পারা একটা দীর্ঘকালীন নিরবিচ্ছিন্ন পদ্ধতি সেহেতু তার সুফল পেতেও আমাদের বহুদিন অপেক্ষা করতে হয়। সাক্ষরতা অভিযানের অনেকগুলি দিক আছে,— প্রথমত,‌ বয়স্ক শিক্ষা প্রকল্প— যারা ইতিমধ্যেই প্রথাগত বিদ্যালয়ে পড়াশোনার বয়স পার হয়ে এসেছেন। দ্বিতীয়ত– নৈশ বিদ্যালয় এর মাধ্যমে কর্মরত মানুষদের প্রাথমিক অক্ষর জ্ঞান ঘটানো, তৃতীয়ত–ড্রপ আউট দের পুনরায় বিদ্যালয়ে আনা বা বিদ্যালয়ের বাইরে রেখেই পূর্ব অর্জিত অক্ষর পরিচয় কে সুদৃঢ় করা। অতিমারীর পরে ভারতবর্ষে বিদ্যালয়ের শিক্ষার হার উদ্বেগ জনক ভাবে সংকুচিত হয়ে গেছে। স্কুল ছুটের সংখ্যা বেড়েছে, প্রথাগত শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে বহু শিশু, কিশোর কিশোরী দূরে সরে গেছে ।ফলে নিরক্ষরতার হার আবার বেড়ে যাবে এমন আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে। সেক্ষেত্রে বিশেষ করে এই ২০২২ এ আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবসের আলাদা একটা তাৎপর্য আছে।

সাক্ষরতা মানে ক্ষমতায়ন,সুস্বাস্থ্য,সচ্ছল জীবন যাপন,লিঙ্গসাম্য প্রতিষ্ঠা।সাক্ষরতা মানে নারী মুক্তি ,দুর্বলশ্রেণীর নারীদের ক্ষমতায়ন।নারী লাঞ্ছনার অবসান।সাক্ষরতা মানে শিশুশ্রমের অবসান,নাবালিকা বিবাহবন্ধ,গার্হস্থ্য হিংসার প্রতিকার,নারী পাচারের ইতি।বিচিত্র সমস্যায় জর্জরিত এ সমাজের একটিই পরশপাথর মুশকিল আসান তা হোল সাক্ষরতা অভিযান।বর্তমানে আন্তর্জাতিক সাক্ষরতার হার চুরাশি শতাংশ।পৃথিবীর পূর্ণবয়স্ক নিরক্ষর মানুষের দুই তৃতীয়াংশ মহিলা।আগামী ২০৫০ সালের মধ্যে ভারতে একশো শতাংশ সাক্ষরতার লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করা হয়েছে।

একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে আমরা একটা জটিল ও সংকটময় মুহূর্তে দাঁড়িয়ে আছি যেখানে সরকার পোষিত বিদ্যালয় গুলিতে শহরাঞ্চলে ক্রমশই ছাত্র-ছাত্রী সংখ্যা কমে যাচ্ছে আবার গ্রামাঞ্চলে স্কুলগুলিতে সেই কাঙ্খিত মানের শিক্ষায় পৌঁছানো যাচ্ছে না। নারী পুরুষের বৈষম্য একটা জ্বলন্ত সমস্যা । বহু প্রচার ও প্রকল্প গ্রহণ করা সত্ত্বেও নারী শিক্ষার হার এখনো সন্তোষজনক নয় এবং মহামারীর পরে এই পার্থক্য আরো প্রকট হয়ে দেখা দিচ্ছে। রূঢ় বাস্তব হলেও তাকে স্বীকার করতে হবে যে অতিমারির পর দীর্ঘ অনভ্যাসের ফলে অনেক ছাত্র-ছাত্রীরই অক্ষর জ্ঞান ঝাপসা হয়ে গেছে। ক্লাস সেভেন এইট এর অনেক ছাত্র-ছাত্রীই ভুলেছে তাদের প্রথম পাঠ। প্রথাগত শিক্ষায় যদি এই মলিন ছবি ফুটে ওঠে তবে সার্বিক সাক্ষরতার হার যে কত নিম্নগামী হচ্ছে তা সহজেই অনুমেয়। ঠিক সেজন্যেই এই সাক্ষরতা অভিযান আবার নতুন উদ্যমে শুরু করতে হবে ।এখনই । অনেকটা সময় আমাদের হারিয়ে গেছে এবং তা আমাদের মত উন্নয়নশীল দেশের অর্থনীতি, জাতীয় আয় এবং সর্বোপরি সমাজ ব্যবস্থাকে ভেতর থেকে দুর্বল করে দেওয়ার পক্ষে তা যথেষ্ট। সুতরাং আর দেরি নয়। প্রথা বহির্ভূত সাক্ষরতা অভিযানকে দ্বিগুণ উৎসাহে সমাজের তৃণমূলস্তর থেকেই কার্যকরী করার উপযুক্ত সময় আমাদের নাগরিক সমাজের দুয়ারে হাজির হয়েছে। এর দায় আমাদের নিতেই হবে।

এডুকেশন ফর অল এই শিরোনামে ইউনেস্কো যে ধরনের শিক্ষার ওপর জোর দিয়েছিল তাতে চারটি স্তম্ভের কথা উল্লেখ করা হয়েছিল প্রথমত লার্নিং টু বি, লার্নিং টু ডু, লার্নিং টু নো, এবং লার্নিং টু লিভ টুগেদার। একটি জীবনমুখী শিক্ষা পদ্ধতির নিদর্শন এটি। সাক্ষরতা অভিযানের মাধ্যমে একটি মানুষকে বা এক জনগোষ্ঠীকে এই ভাবেই হয়ে ওঠা ,কর্মক্ষম করে তোলা, জানার আগ্রহ বাড়িয়ে তোলা এবং যৌথ জীবনযাপনের সহাবস্থানে চলতে শেখানোই অন্যতম উদ্দেশ্য। অতি মারীর পরে আমরা লক্ষ্য করছি প্রথাগত বিদ্যালয়ে গিয়ে শিক্ষার গ্রহণ এর পদ্ধতি অনেকটাই যেন টাল খেয়ে যাচ্ছে। বহুদিন আগেই অস্ট্রিয়ান শিক্ষাবিদ দার্শনিক ইভান ইলিচ ডি স্কুলিং পদ্ধতির প্রয়োগের কথা জানিয়েছেন আমাদের যেখানে বিদ্যালয়ের গণ্ডির বাইরে থেকেও একজন মানুষ স্বয়ং সম্পূর্ণ শিক্ষা পদ্ধতির সুফল ভোগ করতে পারে। বর্তমানে এই ডি স্কুলিং পদ্ধতি অনেকটাই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে ।সাক্ষরতা মিশন এই পদ্ধতি অবলম্বন করে সফলতার স্বাদ পেতে পারে একথা জোর দিয়েই বলা যায়। পৃথিবীর উন্নয়নশীল দেশগুলো দক্ষিণ এশিয়া , আফ্রিকা বা সাব সাহারান দেশগুলিতে ,ব্রাজিল প্রভৃতি দেশে এই ডি- স্কুলিং পদ্ধতির মাধ্যমে সাক্ষরতা অভিযান চলছে এবং তাতে সুফল ও পাওয়া যাচ্ছে।
বর্তমানে ডিজিটাল লিটারেসী র কথা উঠলেও প্রথামাফিক শিক্ষাই যে শেষকথা তা বলার অপেক্ষা রাখে না।মানবসম্পদ হিসাবে ইল-লিটারেট আর ই-লিটারেট মানুষের গুণগত পার্থক্য থাকবেই,স্বীকার করতে হবে।
প্রবন্ধের শুরুর কাহিনীটি ও কিন্তু অতি বাস্তব একটি ডি স্কুলিং এরই প্রত্যক্ষ প্রমাণ। বিকাশোন্মুখ এই মানুষগুলিই আমাদের ভরসা। ভারতের মত দেশে সুস্থায়ী উন্নয়ন যেখানে প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে সেখানে এই প্রথা বহির্ভূত শিক্ষার বাইরে থেকে যাওয়া মানুষগুলিকে সাক্ষর করে তোলা আশু কর্তব্য এবং তারা এই উন্নয়নের শরিক হতে পারলেই সাক্ষরতা অভিযানের উদ্দেশ্য সার্থক হবে। আজ থেকে বহু বছর আগে বেগম রোকেয়া যে পথ দেখিয়েছিলেন ,বাংলায় প্রথম আত্মজীবনী ১৮৬৮সালে প্রকাশিত “আমার জীবন”এর লেখিকা রাসসুন্দরী দেবী (২৫ বছর বয়সে পুত্রের কাছে লিখতে শিখেছিলেন লুকিয়ে) যে অগ্নিশিখা জ্বালিয়েছিলেন সেই আলো আজও জ্বলুক।আশাপূর্ণা দেবীর সুবর্ণলতা যে সাহস দেখিয়েছিলেন আজ নারী পুরুষ নির্বিশেষে প্রত্যেককেই সে সাহসে ভর করে এগিয়ে আসতে হবে। গৃহপরিচারিকা বেবি হালদার সাক্ষর হয়েছেন ,স্বাক্ষর করতে পারেন। মেয়ের কাছে লিখতে শেখা মিড ডে মিলের রাঁধুনি ৩৫ বছরের মা লিখতে শিখেছেন সূর্য ও চাঁদের রচনা। আলো ঝরে পড়ুক —কখনো তীব্র কখনো স্নিগ্ধ ।কিন্তু ঝরুক। অনাবিল অবিরল। সেই আলোয় স্নাত হোক সমাজ। চাঁদ সূর্য শুধুই প্রতীক নয়। আরো আরো বেশি কিছু। প্রতিটি দিনই হোক সাক্ষরতা দিবস।নিরক্ষরতার আঁধার মুছে যাক—–কবির বাণীতে বলি–আমাদের যাত্রা হলো শুরু / এখন ওগো কর্ণধার।।দায়িত্ব দাঁড়িয়ে দুয়ারে,, শুধু কাঁধটা এগিয়ে দিতে হবে।।।

Please follow and like us:

Leave a Reply

Your email address will not be published.