‘ বরাত ফরাত’,’ বোকার হদ্দ’,’ পিশাচেরা’,’ চিচিংফাঁক’,’ ডাইনি সর্বনাশী রাক্ষসী’,’ তুষারিত’,’ গোষ্পদ’ – এই শব্দগুলো বাংলা গানে খুব বেশী নেই।কিন্তু যে কটি আছে তার সবকটাই যিনি প্রয়োগ করেছেন তিনি সলিল চৌধুরী।
আসলে বাংলা গানে এক স্বতঃউৎসারিত ঝর্ণাধারায় স্বতঃস্ফূর্ত গতিময়তার আরেক নাম সলিল চৌধুরী। সুরের বৈচিত্র্যে সহজেই তৈরি করে নিয়েছিলেন এক নিজস্ব ঘরানা। রাগরাগিণীর এবং পাশ্চাত্য গানের প্রয়োগে যে ট্রিটমেন্ট সেখানে সলিল চৌধুরী আনলেন অভিনবত্ব। বহু ক্ষেত্রে রিদমিক প্যাটার্নের মূল কাঠামোয় শব্দ এবং ভাব অনুযায়ী সুর আনলেন।কীর্তনের সুরে তৈরি করলেন প্রতিবাদের গান, মোজার্টের সিম্ফনি, রাশিয়ান বা হাঙ্গেরীয়ান সুরের চলনকে নিজের মতো করে ব্যবহার করলেন। স্কেল বা কর্ড নিয়ে চলতে লাগলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা।নীচু স্বর থেকে হঠাৎ উঁচু স্বরে বা উঁচু থেকে পলকে নিচে নেমে এসে জার্ক দেওয়ার প্রবণতা ঘটালেন নিজের কম্পোজিশনে। এছাড়াও স্কেল চেঞ্জ করে বৈচিত্র্য আনার রীতি অনুসরণ করলেন। গানে হঠাৎ কোমল থেকে শুদ্ধ বা কড়িতে তাঁর সুর ষড়জের মত পাল্টে যেত। এসব তত্ত্বকথা ছাড়াও সলিলসুরের প্রধান উপাদান ছিল উচ্ছলতা এবং সাবলীলতা যা ঝর্ণার মত সঞ্চারমান, গতিময় এবং চঞ্চল ছিল। আসলে সময়ের সঙ্গে তাল মেলাতে পারতেন বলেই সলিল চৌধুরী হয়ে উঠেছিলেন ট্রেন্ডসেটার।
সলিল চৌধুরী গীতিকার, সুরকার, গায়ক, কম্পোজার কিন্তু তার সঙ্গে সঙ্গে অনেক কিছুর সঙ্গে জড়িত ছিলেন। লিখেছেন ‘ড্রেসিংটেবিল’এর মতো গল্প বা ‘অরুণোদয়ের পথে’ -র মতো নাটক। কিংবা ‘শপথ’ বা ‘চাবি’ র মতো কবিতা। ছড়াও লিখেছেন যেগুলো কন্যা অন্তরা চৌধুরীকে দিয়ে গান হিসেবে গাইয়েছেন। পরিচালনা করেছেন হিন্দি ছবি ‘পিঁজরে কে পনছি’ ‘ দো বিঘা জমিন’ এর চিত্রনাট্যকার হিসেবে সলিল চৌধুরীর অবদান আজও আমাদের কাছে বিস্ময়।
দুটি গান তৈরির গল্প এই প্রসঙ্গে বলি।সন্তোষকুমারে ঘোষের কাহিনীনির্ভর কিনুগোয়ালার গলি ছবি মুক্তি পায় ১৯৬৪ সালে।সেই ছবির গান রেকর্ডিং হচ্ছে।সবিতা চৌধুরী গাইবেন’ দখিনা বাতাসে মন কেন কাঁদে’।গোরখকল্যাণ রাগে বাঁধা এই গান হারমোনিয়ামে বাজাচ্ছেন সলিল চৌধুরী।পাশে তবলায় আছেন রাধাকান্ত নন্দী। সারা স্টুডিও স্তব্ধ।সলিলের হারমোনিয়ামবাদনে প্রত্যেকে মুগ্ধ।অবশেষে সবিতা গাইলেন।সে গান আজ ইতিহাস।
কন্যা অন্তরাকে দিয়ে গান গাওয়াবেন।তখন অন্তরা বেশ বড়ো। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে সে তালিম নিচ্ছে। সলিল চৌধুরী দেশ রাগের ওপর একটি গান তৈরি করলেন অন্তরার জন্য। গানটি হলো ‘ এমন সঘন বরষায় তুমি কেন এলে না’।অসাধারণ মিউজিক এরেঞ্জমেন্টে অন্তরা গাইলেন সেই গান।
সৃষ্টিকর্তা এমন এক ক্ষণজন্মা শিল্পীকে আমাদের মাঝে পাঠিয়েছিলেন।বাংলা গানের ৫০ বছরের ইতিহাস সলিল আলোয় আলোকিত।আজ তিনি সশরীরে নেই। কিন্তু রয়ে গিয়েছে তাঁর অসংখ্য কাজ।সেসব নিয়ে আমাদের নিত্য পথচলা। স্রষ্টা সলিল চৌধুরীকে তাঁর জন্মদিনে জানাই প্রণাম।
সব্যসাচী বন্দ্যোপাধ্যায়
১৯ নভেম্বর ২০২ ২
ঋণ স্বীকারঃ
সারেগা পত্রিকা,সলিল চৌধুরী রচনাবলী
