Arambagh Times
কাউকে ছাড়ে না

প্রদীপ গঙ্গোপাধ্যায় : মাকি কাজুমি। এক জাপানি কন্যারত্ন। জাপানের দশতলা বাড়ির ধন ঐশ্বর্য ছেড়ে আমাদের এই বাংলায় এসে , কেবলমাত্র বাউল হবার টানে গুরুর কাছে আশ্রয় নিয়েছেন গ্রামে নদীর পাড়ে এক নির্জন জায়গায়। সেখানে বাঁশের খুঁটি, ঘরের চাল, টয়লেট নেই, আকাশের নিচে বাথরুম, স্নান করার জন্য প্লাস্টিক দিয়ে মুড়ে দেওয়া ঘর, কখনো বা পুকুরে স্নান, জাপানের বিলাসবহুল গাড়ি ছেড়ে এখানে গোরুর গাড়ি…। উৎসবের এক মাস পর, কেবল বাউল হবার টানে তিনি তাঁর জন্মস্থান জাপানের ওসাকা শহরের সবকিছু ছেড়ে মানিয়ে নিতে পারেন নিজেকে গুরুর পরিবেশের কাছে।‌ আর এই ভাবেই আমাদের জীবনধারার সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছেন।
‌ এ এক অদ্ভুত মানবী। অদ্ভুত তাঁর দর্শন। ইংরেজি, জাপানি ভাষার পাশাপাশি এখন ঝরঝরে শুদ্ধ বাংলা বলেন, কখনো বা বলেন সংস্কৃত। আমি ভগিনী নিবেদিতাকে দেখিনি, তবে ছাত্র বেলায় মাদার টেরেজাকে দেখেছি আর বৃহস্পতিবার দিন আরামবাগের গোঁসাই পরব অনুষ্ঠানে চাক্ষুষ করলাম আর এক দেবীকে…মাকি কাজুমি।
আজ থেকে ৩১ বছর আগে সালটা সম্ভবত ১৯৯২; জাপানে ভারতীয় উৎসব চলছে। মাকি কাজুমি তখন ৩২। তাঁর ইচ্ছা হল এই অনুষ্ঠানে গিয়ে পুতুল নাচ দেখার। কিন্তু তিনি পুতুল নাচের পরিবর্তে শুনলেন সাধনদাস বৈরাগ্যর বাউল গান। মাত্র কুড়ি মিনিটের গান শুনেই তিনি হারিয়ে গেলেন নিজের মধ্যে। বাউল হবার তীব্র বাসনায় একমাস পর হঠাৎ একদিন তিনি জাপান থেকে ছয় মাসের ভিসা নিয়ে হাজির হলেন বর্ধমানের শ্যামসুন্দরে। অনেক কষ্ট করে সন্ধান করলেন গুরুজীর আশ্রম। গুরুজী সাধনদাস বৈরাগ্য তখন স্নান করার জন্যে খালি গায়ে গামছা পরে মাটির দুয়ারে বসে তেল মাখছেন। জাপানের বিলাসবহুল দশতলা বাড়ি তখন হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ল ভারতবর্ষের এই পর্নকুটিরে। এই হল আমাদের ভারতবর্ষ!
তারপর ক্রমে ক্রমে আজ তিনি প্রখ্যাত বাউল সাধক সাধনদাস বৈরাগ্যর প্রেমের গুরু….. মা গোসাঁই …..মাকি কাজুমি।
বৃহস্পতিবার আলাপের পর মন প্রাণ ভরে তাঁর গান শুনছিলাম। আর তখনই তাঁর বাম দিকে নিচে বসে বসে গানের তাল দিচ্ছেলেন গুরুজী সাধনদাস বৈরাগ্য।
কেবল বাউল গান শোনা নয়, তাঁদের জীবন বা যাপন চিত্রও জানা দরকার। আর এজন্যই ‘গোসাঁই পরব কালচারাল অ্যন্ড ওয়েলফেয়ার সোসাইটি’-র তরফে চিন্ময় গঙ্গোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় প্রকাশ হয়েছে ‘গোসাঁই কথা’। এই বইতে সাধনদাস বৈরাগ্যের গানের গুরু অনন্তদাস বাউলের জীবন‌ ও যাপনচিত্র নিয়ে আমারও এক লেখা ‘এক পাগলের সন্ধানেঃ অনন্তদাস বাউল’ আছে, যা অনেক অজানা কথার সন্ধান আপনাকে দিতে পারে। উৎসাহী পাঠক সংগ্রহ করতে পারেন। বাড়িতে সযত্নে রেখে দেবার মতন বই।

আর আরামবাগের একদল যুবক-যুবতী কেবলমাত্র ‘মানুষ খোঁজা’র জন্য নিরলস পরিশ্রম করে এই ধরনের রুচি সম্পন্ন একটা মেলা করতে পেরেছে, তারা বয়সে আমার থেকে অনেক ছোট হলেও তাদের জন্য রইলো অন্তর থেকে শ্রদ্ধা।

Please follow and like us:

Leave a Reply

Your email address will not be published.