Arambagh Times
কাউকে ছাড়ে না

বাংলা সাহিত্যে চর্যাপদের আমল থেকে কবিতার ভাব ভাষা ও আঙ্গিক পরিবর্তন হতে হতে সত্তর দশকে আবির্ভাব ঘটে একদল সম্ভাবনাময় কবি। সত্তরের কবিরা কবিতায় শিল্প ও বক্তব্যের ভারসাম্য এনেছেন, প্রতিদিনের ভাষাকে ফিরিয়ে এনেছেন কবিতার দিকে।
সত্তরের কবিরা নিসর্গের অনুষঙ্গের প্রতি বারবার অনুরক্ত থেকেও নাগরিকতার প্রতি আকর্ষণ জাত আত্মকথনের রীতিকেও কেউ কেউ অনুসরণ করেছেন। সমকালকে কবিতার মধ্যে ধারণ করার সযতœ প্রয়াসও সত্তরের কবিদের অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ। সত্তরের কবিতায় সময় চেতনার যে সুরটি শোনা যায় তা সমকালীন সার্বিক চিন্তা চেতনার ফল। সময় মথিত গরল ও অমৃতের স্বাদ একই সময়ে উঠে এসেছে সত্তরের কবিতায়।
সত্তরের কবিদের কবিতায় মানুষ এসেছে, মানুষের জীবন এসেছে শ্রমে-ঘামে, আনন্দে-বিষাদে। কারও কারও কবিতায় নিসর্গ ও প্রেম এসেছে প্রথাগত ভাবে। নষ্টালজিক বেদনাও মিশে আছে অনেকের কবিতায়। অনেকের কবিতায় এক নির্জন ধ্যানী আবহ আছে যা সুন্দরের, কল্যাণের ও আনন্দের এক বহুমাত্রিক অনুষঙ্গ। এই প্রজন্মের কবিদের জীবনের প্রতি, প্রকৃতির প্রতি আস্থা ও ভালবাসার আকর্ষণ জন্মলব্ধ। কালক্রমে এই সব অনুভব হতে থাকে গভীর ও গভীরতর। সত্তরের কবিতা খুঁজে বেড়ায় জীবনের সুন্দরকে এবং প্রকৃতির সুন্দরকে।
সত্তর দশক বাংলা কবিতায় বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য এক দশক। এই দশকের কবিদের প্রধান প্রবণতা সমূহকে মূলত চার ভাগে ভাগ করা যায় ঃ মৃত্তিকা সংলগ্ন দেশপ্রেম তথা সমাজ মনস্কতা; আধা-মফস্বলীয় নাগরিক চেতনা-মিশ্রিত প্রকৃতি প্রিয়তা; রোমান্টিকতা তথা নষ্টালজিক বেদনা এবং আত্মমগ্ন নির্লিপ্ততা ও অন্তর্মুখিতা। সত্তরের কবিরা নিজেদের নির্মিত কাব্যধারায় বাংলাদেশের কবিতায় আনে প্রকরণ গতি পরিবর্তন, কবিতা হয়ে উঠে সমাজজাত এবং কখনো কখনো প্রতিবাদী উচ্চারণে ঋদ্ধ। তারা বাংলা কবিতার মূল প্রবাহে যোগ করে নতুন গতি। এসব কবিরা নিজেদের নির্মিত কাব্যভাষায় জীবনঘন রহস্যে কবিতা বুনেছেন আপন শক্তিতে। এ দশকের অনেক কবির কবিতায় মানস ভ্রমণ আছে যা তাদের একান্ত স্বকীয়।
সত্তরের কবিরা অভিজ্ঞতার সরণী ছুঁয়ে ছুঁয়ে বিচ্ছিন্ন বিষন্নতা থেকে শুরু করে নির্মিতির বিশুদ্ধতায় একাগ্রভাবে নিবিষ্ট। এভাবে তারা বিশ্ব মানবিকতার দিকে এগিয়ে গেছেন। আর তাই সত্তরের স্থিত প্রাজ্ঞ কবিদের অনেকেই ঐতিহ্যসন্ধানী ও বিশ্ববাদী। এরা ব্যক্তিসর্বস্ব প্রেম-ভালবাসা, আনন্দ-বিষাদ, আর দুঃখবোধক অতিক্রম করে বাংলা কবিদেরকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন এক আন্তর্জাতিক বহুজনীনতায়। জীবনের বহুমাত্রিকতা আর অমিত সম্ভাবনা সত্তরের কবিতাকে দিয়েছে অতলান্ত গভীরতা। অভিজ্ঞতার সঙ্গে এসেছে ভাষার আধুনিকতা, যা সত্তরের কবিরা অর্জন করেছেন নানা আঙ্গিকের আলো অন্ধকারে অবিরাম পরীক্ষা-নিরীক্ষার দীর্ঘ পথ পরিক্রমার মধ্য দিয়ে।
সত্তর দশকে বহু সংখ্যক কবির আবির্ভাব ঘটেছিল সময়ের প্রয়োজনে। এদের অনেকে এখন সক্রিয় নয়। কোনো দশকেরই সব কবি শেষ অবধি টিকে থাকেন না, কিন্তু সবার মিলিত প্রয়াসে একটি দশকের বিশিষ্টতা উজ্জ্বল হয়ে ফুটে ওঠে। এ কথা ঠিক যে, বাংলাদেশের তথা বাংলা কবিতাঙ্গন এখন সত্তরের কবিদের দখলে বলা যায়। এক নতুন বেদনার্দ্র জাগরণের বার্তা নিয়ে তারা বাংলা কবিতায় আবির্ভূত হয়েছিলেন। এক মহান সময়ের কাব্য-আন্দোলনের ঘনিষ্ঠ অংশিদার হিসেবে এরা অবশ্যই গর্বিত শব্দসেনা। অনেকেই থেমে গেছেন, অনেকেই নিভে গেছেন সময়ের স্বাভাবিক নিয়মে। কিন্তু সব ঝড়ো হাওয়া ও দীর্ঘ পথশ্রমে সকল বাধা পেরিয়ে যারা আজ বাংলা কবিতার নিয়ন্ত্রণভার নিজেদের হাতে তুলে নিয়েছেন তারা হলেন ঃ ময়ুখ চৌধুরী, দাউদ হায়দার, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শঙ্খ ঘোষ, নূরুল হুদা, মাহবুব হাছান, পবিত্র সরকার, বিমল গুহ, নাসির আহমেদ, তৌহিদ আহমেদ, আশীষ মিশ্র, নিতাই সেই, রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, কামাল চৌধুরী, মৃণাল চক্রবর্তী, ত্রিদিব দস্তিদার, আবু করিম, সাথী দাস, আসাদ মান্নান, মজিদ মাহমুদ, মুজিবুল হক কবীর, জাহাঙ্গীর ফিরোজ, স্বপন দত্ত, আতাহার খান, মাহমুদ কামাল, নাসিমা সুলতানা, আবিদ আনোয়ার, ফারুক মাহমুদ, সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল,   রবীন্দ্র গোপ, শামীম আজাদ, মোহন রায়হান, জরিনা আখতার, সৈকত আসগর, মতিন বৈরাগী, ইকবাল আজিজ, মাহবুব বারী, সুজন হাজারী, জাহিদ হায়দার, সৈয়দ হায়দার, কাজলেন্দু দে, হারুন রশীদ, খুরশীদ আনোয়ার, জাফর ওয়াজেদ, তুষার দাস, শফিক আলম মেহেদী, শাহবুদ্দীন নাগরী, মোরশেদ শফিউল হাসান, হাসান হাফিজ, মাহমুদ শফিক, মিনার মনসুর, মুনীর সিরাজ, বাবু ফরিদী, শাহাদাত বুলবুল, আফসার হাবীব, আশরাফ আহমদ, আবু হাসান শাহরিয়ার, কামাল মাহমুদ, মাসুদুজ্জামান, হালিম আজাদ, শহীদুজ্জামান ফিরোজ, সোহরাব হাসান, মুহম্মদ সামাদ, তপংকর চক্রবর্তী, তিতাশ চৌধুরী, ফজল মাহমুদ, আবু মাসুম, আশরাফ মীর, শাহজাদী আঞ্জুমান আরা, সৈয়দ আল ফারুক, ইকবাল হাসান, শিশির দত্ত, দিলারা হাফিজ, সুজাউদ্দিন কায়সার, আলমগীর রেজা চৌধুরী, প্রণয় মজুমদার, আলেয়া চৌধুরী, শামসুল ফয়েজ, সুনীল নাথ, আনন্দ মোহন রক্ষিত, খালিদ হাসান, জিয়া হায়দার, আকাশ মাহমুদ, মোহিত-উল-আলম, নুরুন্নাহার শিরীন, শাহেরা খাতুন বেলা, আফরোজা অদিতি, খোশনূর আলমগীর, খালিদ হোসাইন, তাহমিনা কোরাইশী, ওয়াহিদ রেজা, বাবুল পাটোয়ারী, মশউদ-উশ-শহীদ, মৃদুল গুহ, সুরাইয়া খানম, মাসুদ বিবাগী, স্বপ্না রায়, রেজা সেলিম, সোহেল অমিতাভ, কাজী রফিক, আহমদ খালেদ কায়সার, মোস্তফা মীর, রবীন্দ্রনাথ অধিকারী প্রমূখ সত্তর দশকের দীর্ঘ কবি তালিকাকে সমৃদ্ধ করেছে। এদের কেউ কেউ এখন আর না লিখলেও অধিকাংশই পরবর্তী দশক সমূহে প্রবলভাবে সক্রিয় রয়েছেন।
আবিদ আজাদ সত্তরের উল্লেখযোগ্য কবি হিসেবে ইতিমধ্যে নিজের আসন পাকাপোক্ত করে নিয়েছেন। শুরু থেকেই আবিদের উপস্থিতি অত্যন্ত সরব। বিষয়, প্রকরণ, চিত্রকল্পের নির্মিতি আর কাব্যকুশলতার ক্ষেত্রে আবিদ আজাদ এক অসাধারণ কারিগর। ষাট দশকের শহরমূখী নাগরিক কাবতাকে আবিদ আবার স্বতঃস্ফুর্ততা ও নতুন এক নান্দনিক চেতনার মিশেলে অসাধারণ করে তোলেন। দীর্ঘ স্মৃতিমূলক কবিতায় আবিদ অত্যন্ত সিদ্ধহস্ত।
শিহাব সরকার সত্তর দশকের অন্যতম প্রধান কবি। তার কবিতায় মিথের নিপুণ ব্যবহার ও ইতিহাস চেতনা আলাদা মাত্রা পেয়েছে। শিহাব সরকার নাগরিক কবি। তার কবিতায় দেশ-কাল সমাজের উপস্থিতি প্রবল। নরম পেলব ছন্দের কারু কাজের চেয়ে শিহাব টান টান গদ্য ছন্দে কবিতা লিখতে পছন্দ করেন। ময়ুখ চৌধুরী অত্যন্ত ব্যাকরণ সম্মত ছন্দ সচেতন কবি। তিনি সত্তর দশকের মেধাবী ও শক্তিশালী কবিদের অন্যতম। নিটোল প্রেমের কবিতা দিয়ে স্বাধীনতা পূর্বকালে যাত্রা শুরু হলেও স্বাধীনতা উত্তরকালে তাঁর কবিতায় উঠে এসেছে মুক্তিযুদ্ধ, তার অনুসঙ্গ রাজনীতি, অর্থনীতি, ক্ষুধা-দারিদ্র ভয়-ভীতি, সন্ত্রাস, নিরাপত্তাহীন মানব জীবন, খরা ও খাদ্য সংকট, রাজনৈতিক হত্যা, ব্যর্থতা, দৈশিক ও বৈশ্বিক অস্থিরতা, পরমাণু মারণাস্ত্রের ভীতি-শংকা এবং মানবতা বিরোধী কথামালা। এক কথায় জীবন দর্শনের বহুমুখী ও বিচিত্র দিকগুলো যেমন গভীর অর্ন্তদৃষ্টিতে ময়ুখ চৌধুরীর কবিতায় বাঙময় হয়েছে, তেমনি মানুষের মনোজগতের রহস্যময় নান্দনিকতাও অত্যন্ত শক্তিশালী ভঙ্গিতে ফুটে উঠেছে তার কবিতায়। সত্তর দশকের কবিদের মধ্যে রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ এক প্রচন্ড সৃজনীশক্তি নিয়ে শুরু করেছিলেন তার পথযাত্রা। তার কবিতায় দেশ মাটি মানুষ মিলে আবহমান বাংলার চিরায়ত এক রূপ উঠে এসেছিল। কিন্তু তার অকাল মৃত্যু সকল সম্ভাবনাকে কালো পর্দায় ঢেকে দিয়ে গেছে।
মাহবুব হাসান উপমা, প্রতীক আর চিত্রকলা ব্যবহারের অবাধ স্বাধীনতা নিয়েছেন। মাহবুব হাসানের কবিতায়ও মিথের সার্থক প্রয়োগ লক্ষ্যণীয়। বাংলার নদী, নারী, প্রকৃতি ও মানুষ মাহবুবের খুব প্রিয় বিষয়। নাসির আহমেদের কবিতা এক ধরণের গীতলতায় ভরা। সত্তরের উল্লেখযোগ্য কবিদের অন্যতম, নাসিরের কবিতায় এখনও নতুন নতুন পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও ভাঙচুর লক্ষ্য করা যায়। নাসির আহমেদ ছন্দ সচেতন ও সমাজমনস্ক কবি। তৌহিদ আহমেদ ছন্দ সচেতন কবি। তিনি আধুনিক পটভূমিকা লোকজ শব্দের ব্যবহার করে থাকেন অসাধারণ দক্ষতায়। দৃশ্যপট নির্মাণ ও উপমার অভিনবত্বে তৌহিদ এক আলাদা মেজাজের কবি। তৌহিদের কবিতায় বহুমাত্রিকতা, রহস্যময়তা, চিত্রকল্প নির্মাণে দারুণ দক্ষতা তাকে সত্তরের প্রতিভাবান ও শক্তি সম্পন্ন কবিদের অন্যতম হিসেবে পরিচিতি এনে দিয়েছে।
নিতাই সেন অত্যন্ত পরিশ্রমী, অতিমাত্রায় রোমান্টিক এক মিষ্টি স্বভাবের কবি। ফেলে আসা দিনের স্মৃতিগান্ধী অকৃত্রিম নষ্টালজিয়া নিতাইয়ের কাব্যভুবনকে ঘিরে রেখেছে। নিতাই সেন ভাবাবেগ তাড়িত সাম্প্রদায়িকতা মুক্ত এক ভালবাসা পূর্ণ বিশ্বের চিত্রকর। চিন্তায় নতুন নতুন দিগন্ত উন্মোচন, শব্দ ও চিত্রকল্পের সুনিপুণ প্রয়োগ এ কবির নিবিষ্টতার সাক্ষ্য দেয়।  বিমল গুহ রোমান্টিক কবি। সমকালকে তিনি এমনভাবে শব্দবন্দি করে যে, তা ইন্দ্রিয়স্পর্শী হয়ে উঠে। স্বদেশ চেতনা বিমল গুহের কবিতার অন্য একটি প্রধান সুর। তিনি লিরিকধর্মীতার পাশাপাশি সমকালীন সমাজ পরিবেশের ছবি এঁেকছেন সুনিপূণ দক্ষতায়। উপমা ব্যবহারের চমৎকারিত্বে ও বস্তু বিশ্বের চিত্রকল্প নির্মাণে ছন্দ সচেতন এ কবি অত্যন্ত সিন্ধহস্ত। সত্তরের শক্তিশালী কবিদের মধ্যে বিমল গুহ অন্যতম।
মাশুক চৌধুরী সত্তরের শীতল ধারা কবিদের একজন। কামাল চৌধুরী প্রতিনিয়ত নিরীক্ষার ভেতর দিয়ে অগ্রসরমান। ত্রিদিব দস্তিদার সত্তর পাঠক নন্দিত একজন শক্তিশালী কবি। তার কবিতার ভয়ানক লজিকবিহীন দৃশ্যপট অনভিজ্ঞ পাঠককে নিঃসন্দেহে এক কঠিন দোটানার মধ্যে ফেলে দেয়। মুক্তিযোদ্ধা কবি সাথী দাসের কবিতায় দ্রোহ ও দাহ উভয়ই বিদ্যমান। লাজুক লিরিকের ভেতর ডুবে থাকা স্বপ্না রায়ের কবিতার শিল্পসত্য ও বস্তুসত্য অস্বীকৃত হয় না।  খুরশিদ আনোয়ার, কবিতার পাশাপাশি গীতিকার হিসেবেও বেশ জনপ্রিয়। তাছাড়া বিদেশী কবিতা অনুবাদে এ কবি খুবই সাফল্যের পরিচয় দিয়েছেন। আবিদ আনোয়ার, ফারুক মাহমুদ, রবীন্দ্র গোপ, সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল এদের কাব্যনিষ্ঠা, নিরলস চর্চা, সততা ও মেধা এদেরকে এই দশকের উল্লেখযোগ্য কবি হিসেবে পরিচিতি দিয়েছে।
আবু করিম শুরু থেকেই নিজেকে আলাদা এবং বিশিষ্ট বলে চিহ্নিত করতে পেরেছিলেন। আসাদ মান্নান দীর্ঘ পয়ারে কঠিন শব্দচয়নে কবিতা লিখতে ভালবাসেন। অসম্ভব স্মৃতিশক্তি সম্পন্ন সত্তরের এ কবি অনায়াসে একের পর এক নিজের কবিতা আবৃত্তি করতে পারেন। মুজিবুল হক কবীরের কবিতায় নীরিক্ষা লক্ষ্যণীয়। তার ছন্দ জ্ঞান প্রখর। জাহাঙ্গীর ফিরোজ ঐতিহ্য সচেতন কবি।
স্বপন দত্তের কবিতা শুদ্ধ ও সংহৃত। আতাহার খান গভীর সমকাল ভেদী ও আশাদীপ্ত কবি। মাহমুদ কামাল অন্তরাল পরায়ণ ও কিছুটা নিঃশব্দ স্বভাবের কবি। নাসিমা সুলতানা ঋজু সাহসী স্পষ্ট ও দ্বিধাহীন। বাংলা কবিতার দুর্ভাগ্য যে এ বিরলপ্রজ কবি লোকান্তরিত হয়েছেন।
 মোহাম্মদ সামাদ ও মোহন রায়হান রাজনীতি সচেতন কবি। জাহিদ হায়দারের কবিতায় বিষয় বৈচিত্র্য, ছন্দ সচেতনতা লক্ষ্যণীয়। বিশেষ করে মাত্রাবৃত্তে তিনি সাবলীল। সুজন হাজারী এক নিভৃতচারী নিবেদিত সত্তরের কবি। তার কবিতার ভাষা মৃদু, গীতল ও রোমান্টিক। সৈকত আসগর, মতিন বৈরাগী আত্মমগ্ন কবি। শামীম আজাদ, জরিনা আখতার স্বচ্ছ ও সহজবোধ্য। এরা সত্তরের গীতল ধারার কবি। ইকবাল আজিজ পরিমিতিবোধ সম্পন্ন আত্মমগ্ন কবি। মাহবুব বারী কবিতায় ধীরলয়ে কথা বলেন। খুরশীদ আনোয়ার বক্তব্য প্রধান কবিতা লিখতে সিদ্ধহস্ত। কাজলেন্দু দে, হারুণ রশীদ, জাফর ওয়াজেদ, তুষার দাশ, সৈয়দ হায়দার এরা প্রত্যেকেই সত্তর দশকের মূলস্রোতে থেকে নিজেদের জন্য স্থান করে নিয়েছেন। শফিক আলম মেহেদী সত্তরের একজন মৃদুভাষী গীতল ধারার কবি। তার কবিতার বিষয়বস্তু অনেক ক্ষেত্রেই ব্যক্তিগত জীবন যাপনের সুখ-দুঃখ। শাহাবুদ্দিন নাগরী ছন্দ সচেতন প্রেমিক কবি। মোরশেদ সফিউল হাসান আত্মমগ্ন নিবেদিত কবি। হাসান হাফিজ সহজ ভাষায় লিখতে পারদর্শী ছন্দ সচেতন কবি। মাহমুদ শফিক, মিনার মনসুর, মুনীর সিরাজ, শাহাদাত বুলবুল, বাবু ফরিদী, আশরাফ আহমদ, এঁরা ক্রমাগত নির্মাণ করেছেন, কবিতাকে ভেঙ্গে ফেলছেন আবার নির্মাণ করছেন। আফসার হাবিব, আবু হাসান শাহরিয়ার নিজেদের জন্য নতুন কাব্যরুচি নির্মাণ করেছেন। কামাল মাহমুদ, হালিম আজাদ আত্মমগ্ন হলেও উচ্চকিত। শহীদুজ্জামান ফিরোজের কবিতা সহজ ভঙ্গিতে উচ্চারিত হলেও এর গঠন নিটোল সত্তরের কবিতা এখন পরিণত। এরা বাংলা কবিতার মূল ধারায় উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে চলেছেন, তাদের সমকালের কাব্যস্রোতে প্রবাহমান সত্তরের কবিতা একুশ শতকের নতুন দিক নির্দেশনা দিচ্ছে।
পরবর্তীতে অনেক নতুন কবির আবির্ভাব ঘটেছে কাব্যসাহিত্যে, কিন্তু তাদের অধিকাংশই স্বল্পায়ু। বিচ্ছিন্নভাবে কিছুদিন লেখালেখি করার পর আবার হারিয়ে যান। যে কারণে সত্তরের কবিরা আজও কাব্যভূবনকে সমৃদ্ধ রেখেছেন। তবে কিছু কিছু তরুণ কবি ভাল লিখছেন, মফস্বল শহরে ভাল কবিতা লিখেও অনেকে জাতীয় দৈনিকে প্রকাশের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। সাহিত্যে স্বজনপ্রীতিটা অনেক ক্ষেেেত্রই প্রতিভাবানদের বিড়ম্বনায় ফেলেন। ব্যক্তি পরিচয়টা প্রকাশনা ক্ষেত্রে বড় জায়গা দখল করে রেখেছে। এছাড়াও রয়েছে সৌখিন ও সুবিধাবাদী এবং ব্যক্তি প্রচারউন্মুখ কিছু ব্যক্তি। যারা নিজেকে কবি হিসেবে জাহির করতে স্বল্পকালীনভাবে সাহিত্য জগতে প্রবেশ করেন। পত্রিকার সম্পাদক কিংবা সংগঠক প্রথমে দয়া পরবেশ কিংবা আন্তরিকতায় আবদ্ধ হয়ে তাদের অগোছালো কবিতাকে ঘষামাজা করে কবিতা বানিয়ে পত্রিকায় প্রকাশ করেন। প্রথম প্রথম তারা পত্রিকাতে সহমর্মীতাও প্রকাশ করেন পরবর্তীতে বিষফোঁড়া হয়ে পত্রিকার বা সংগঠনের প্রাণটাকেই নিঃশেষ করে ফিরে যান আপন আলয়ে। এভাবে বহু পত্রিকা ও সংগঠনের অকাল মৃত্যু হয়েছে। মূলত এরাই সুস্থ সাহিত্যচর্চা ও বিকাশের প্রধান অন্তরায় বলে ভুক্তভোগী সম্পাদক ও সাহিত্যানুরাগীদের ধারণা। এরাই সাহিত্যের এইড্স, সৌখিন ও সুবিধাবাদী কবিদের থেকে সতর্ক থেকে প্রতিবন্ধকতার মাঝেও অনেক প্রতিভা স্বমহিমায় নিজ জায়গা গড়ে নিতে পেরেছেন। বাস্তবে জীবনবাদী সমাজ সচেতন কবিরা হয় আত্মনিবেদীত প্রাণ। তাঁদের হৃদয় নিঃসৃত কথামালা কবিতার পঙক্তি হয়ে ভেসে ওঠে। যেখানে প্রতিরূপ পায় চলমান সমাজ জীবনের নানা দৃশ্য। একজন কবির জীবনের অব্যক্ত অনুভূতিগুলো তার কলমে কবিতা হয়ে প্রস্ফুটিত হয় নান্দনিক শব্দচয়নে।
পরিশেষে দীর্ঘ দিনের সাহিত্য সাধনা ও পত্রিকা/বই সম্পাদনার অভিজ্ঞতার আলোকে বলবো আমরা সৃষ্টি সুখের উল্লাসে মাতোয়ারা একথা যেমন সত্যি তেমনি সত্যি আমরাই সৌখিন/মেকী কবিদের আশ্রয় প্রশ্রয় দিয়ে সৃজনশীল সাহিত্যঅঙ্গনকে নোংড়া করছি। বিচক্ষণ সম্পাদকগণ কবিতা পেলেই কিংবা কেউ কবি হিসেবে এলেই তাকে সমাদরে বরণ করবেন না। একটু যাচাই বাছাই করে সাহিত্যের মূল্যায়ন করে তবেই প্রকাশ করবেন। যদিও ব্যাঙের ছাতার মতো অসংখ্য পত্রিকা আর সম্পাদকের ছড়াছড়ি সারা বাংলা জুড়ে। তারাই বাংলা কবিতার পরিমন্ডলকে বিভ্রান্ত করছে, ৫/১০টি কবিতা লিখেই কিছু টাকা সহায়তা দিয়ে বাংলা সাহিত্যের শিরোমণিদের নামাঙ্কিত পদক সনদ অর্জন করছেন, যা নিতান্তই লজ্জাজনক। তবুও সুস্থ সাহিত্যের বাতাবরণে আত্মনিবেদীতপ্রাণ সাহিত্যপত্রিকার সম্পাদকগণের সুদৃষ্টি একান্তই কাম্য।

লেখক: কবি, প্রাবন্ধিক ও গল্পকার, সদস্য বাংলা একাডেমি, ঢাকা, সভাপতি, বাংলাদেশ কবিতা সংসদ, পাবনা।
পাবনা, বাংলাদেশ। মুঠোফোন: +৮৮০১৭১২৫৮৩৩৭০।

Please follow and like us:

Leave a Reply

Your email address will not be published.