Arambagh Times
কাউকে ছাড়ে না
exam

বিশ্বদেব চট্টোপাধ্যায় – প্রথমেই একটা জরুরি কথা বলে রাখা দরকার–আজ মাধ্যমিকের যে ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে তাতে এই রাজ্যের প্রায় ১১ লক্ষ পরীক্ষার্থীর কোনো ভূমিকাই নেই। পরীক্ষা না দিয়ে–প্রতিযোগিতায় নিজের যোগ্যতা বা মেধার প্রমাণ রাখার সুযোগ না পেয়ে কম বেশি ৮০% পরীক্ষার্থী খুশি হয় নি। তাদের এই মার্কশিট তাদের চোখমুখ উজ্জ্বল করে নি। ভবিষ্যতে তাদের এই ফলাফলের মূল্যায়ণ কী ভাবে হবে তাই নিয়ে তারা উদ্বেগ বোধ করছে। সুতরাং পরীক্ষার্থীদের নিয়ে কোনোরকম ট্রোল বা খিল্লি সুস্থ মানসিকতার কেউ করছেন বা করবেন বলে আমার মনে হয় না। শিক্ষার্থীদের জীবন থেকে নয় নয় করেও চার-চারটি বছর অতিমারির প্রভাবে প্রায় খতম হয়ে গেল। ২০২০ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত অতিমারির প্রভাবের জের থাকবে। শিক্ষার্থীরা প্রাণপণে চেষ্টা করে যাবে তাদের ক্ষতি সামলাতে। অনেকেই পারবে না নানান প্রতিকূলতার কারণে। আর্থিক ও পারিবারিক অক্ষমতার কারণে। তবু তাদের যথাসাধ্য উৎসাহিত করতে হবে–তাদের পড়াশোনার জীবনে যাতে দাঁড়ি না পড়ে যায় সেটা দেখতে হবে। প্রকৃতপক্ষেই আজকের এই বাচ্চাগুলোর কোনো অপরাধই নেই। তারা সকলেই অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতির শিকার। তাদের জন্যে আমাদের শুভকামনা থাকা উচিত।
৭০০ নম্বরের মধ্যে ৬৯৭ নম্বর পেয়ে মাত্র ৭৯ জন প্রথম স্থান অধিকার করার মতো নজির এর আগে শিক্ষার ইতিহাসে কোথাও ছিল না। কাজেই এই ব্যাপারটা আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে এসেছে। আমার ধারণা–এই সংখ্যাটা অনায়াসে ৪/৫ হাজার হতে পারতো–হওয়া অবশ্যই উচিত ছিল। পরীক্ষার্থীর সংখ্যা যেখানে প্রায় ১১ লক্ষ এবং এই বিপুল সংখ্যক পরীক্ষার্থীর নবম শ্রেণীর চূড়ান্ত পরীক্ষার ফলাফলের সঙ্গে দশম শ্রেণীর (কতটা কি পরীক্ষা হতে পেরেছিল জানি না) কোথা থেকে কত নম্বর যোগ হয়েছিল পরিষ্কার জানা না গেলেও প্রতিটি বিষয়ের জন্যে স্কুলগুলো যে নম্বর পাঠিয়েছিল তার ভিত্তিতে যে ফলাফল তৈরি হয়েছে তাতে দেখা গেল ১০০% পরীক্ষার্থী পাশ করলেও একজনও ৭০০’র মধ্যে ৭০০ পায় নি–নাকি ইচ্ছে করেই দেওয়া হয় নি? ১১ লক্ষ পরীক্ষার্থীর মধ্যে মাত্র ৭৯ জন ৭০০’র মধ্যে ৬৯৭ নম্বর পেয়ে প্রথম হল–যে পদ্ধতিতে মার্কশিট তৈরি করা হল সেই পদ্ধতি কি সত্যি সত্যি ত্রুটিমুক্ত এবং ১১ লক্ষ পরীক্ষার্থীর জন্যে সঠিক ছিল? সংশয় কিন্তু থাকছেই। এই ফলাফল কিন্তু রাজ্যের মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাব্যবস্থার বিরুদ্ধে রীতিমতো প্রশ্ন তুলে দিচ্ছে। কর্ণাটকে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার্থীদের যে ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে সেখানে দেখা যাচ্ছে প্রায় আড়াই হাজার পরীক্ষার্থী ৬০০’র মধ্যে ৬০০ নম্বর পেয়ে প্রথম হয়েছে। এর মধ্যে কিন্তু রসিকতা করার মতো কিচ্ছু নেই–এখানেও সংখ্যাটা কম হলেও প্রকৃতপক্ষে এমনটাই হওয়ার কথা। কারণ, এখানেও পরীক্ষা হয় নি–সুতরাং যে পদ্ধতিতে ফলাফল তৈরি করা হয়েছে তাতে ১০০’র মধ্যে ১০০ পাওয়া পরীক্ষার্থীর সংখ্যা যথেষ্ট পরিমাণেই থাকার কথা। রাজ্য মাধ্যমিক শিক্ষা দপ্তর ফলাফল বাস্তবসম্মত দেখাতে গিয়ে রাজ্যের স্কুলগুলোতে যে আজকাল পড়াশোনা কিছুই হচ্ছে না সেটাই প্রকাশ্যে তুলে ধরলেন। ১১ লক্ষ ছাত্রছাত্রীর মধ্যে মাত্র ৭৯ জন ৬৯৭ নম্বর পেলে বুঝতে অসুবিধে হয় না নবম-দশম শ্রেণীতে ছাত্রছাত্রীদের যোগ্যতা মান ঠিক কোন স্তরে ছিল। অনেক স্কুল নাকি বেশি বেশি নম্বর পাঠিয়েছিল–তবু ফলাফলের এই হাল যথেষ্ট পরিমাণে উদ্বেগজনক। আশাব্যঞ্জক নয়। প্রায় সাড়ে ন’লক্ষ পরীক্ষার্থী প্রথম বিভাগে পাশ করল–কিন্তু ১০০-তে ১০০ পেল না একজনও ! কর্ণাটকে কিন্তু প্রায় আড়াই হাজার ছেলেমেয়ে ১০০-তে ১০০ পেয়েছে ! এর মধ্যে কোনোরকম অস্বাভিকতা নেই। অস্বাভাবিকতা প্রকট হল এই রাজ্যের মাধ্যমিক বোর্ডের ফলাফলে। বহু ছাত্রছাত্রী নম্বর কম দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ তুলেছে।
গত বছর ৮৬%-এর বেশি ছাত্রছাত্রী পাশ করেছিল। এবারে সেই সংখ্যাটা গিয়ে দাঁড়ালো ১০০%-তে। যারা মাধ্যমিক পাশ করে তাদের অনেকেই উচ্চমাধ্যমিক স্কুলে ভর্তির সুযোগ না পেয়ে পড়াশোনা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। যারা পাশ করতে পারে না তাদের সংখ্যাটা এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে যে সংখ্যা দাঁড়ায় সেটাই প্রকৃত ড্রপ-আউটের সংখ্যা। এবারে ১১ লক্ষ পরীক্ষর্থী পাশ করেছে–এদের একটা বিরাট অংশ উচ্চমা্ধ্যমিকে ভর্তির সুযোগ পাবে না। যারা ভর্তি হবে তাদের অ্যাডমিশন টেস্ট দিতে হবে না। পরীক্ষা না দিয়ে ‘অর্জিত’ নম্বরের ভিত্তিতে যারা যে বিভাগ বেছে নেবে তাতে তারা কতদূর সফল হবে তা নিয়ে প্রবল আশঙ্কা ও উদ্বেগ থাকবে। তারপর কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবিষ্যৎ তারা কিভাবে গড়তে পারবে তা নিয়ে কিন্তু প্রশ্নের পর প্রশ্ন তৈরি হয়ে গেল এই ফলাফলে। প্রায় একই ঘটনা ঘটতে চলেছে উচ্চমাধ্যমিক ফলাফলের ক্ষেত্রেও।
১০০% সাফল্যের একটা সুফল কিন্তু পেতে চলেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। গ্রামে গঞ্জের মানুষ আপ্লুত হয়ে মমতাকে ধন্য ধন্য করবে। তাদের সব ছেলেপিলে মাধ্যমিকের সার্টিফিকেটটা তো দিদির দৌলতে পেয়ে গেল ! লক্ষ লক্ষ অভিভাবকের কৃতজ্ঞতার মূল্য তো কিছু কম নয়–২০২৩ পর্যন্ত এই ডিভিডেণ্ড আসতেই থাকবে। ২০২৪-এর জন্য এই ডিভিডেণ্ড অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ভূমিকা পালন করবে।
বিশ্ব শিক্ষাব্যবস্থার ইতিহাসে নজিরবিহিীন রেকর্ড তৈরি হলেও ৭০০’র মধ্যে ৭০০ পাওয়ার সুযোগ হাজার পাঁচেক পরীক্ষার্থী পেলে অস্বাভাবিক কিছু হত না–কারণ, করোনা বিধি মেনে ছাত্রছাত্রীদের পরীক্ষার ব্যবস্থা না করে যে পদ্ধতিতে নম্বর বিতরণের মাধ্যমে ফলাফল তৈরি করা হল তার মধ্যেই তো কোনোরকম স্বাভাবিকতা নেই। তাহলে শুধু শুধু কেন বাস্তবতার দোহাই দিয়ে পরীক্ষার্থীদের বঞ্চিত করা হল কে জানে ! আজ সারাদিন সামাজিক মাধ্যমে মাধ্যমিক ফলাফল নিয়ে যেসব মন্তব্য উঠে আসছে তার মধ্যেও তাই অস্বাভাবিকতা কিছু নেই। পরীক্ষার্থীদের অপরাধী গণ্য করাটা অবশ্য ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ হিসেবেই গণ্য হবে বোধবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের কাছে !!

Please follow and like us:

Leave a Reply

Your email address will not be published.