Arambagh Times
কাউকে ছাড়ে না

সব্যসাচী বন্দ্যোপাধ্যায় : সালটা ১৯৭৪।সেবার এইচ এম ভি কর্তৃপক্ষ ঠিক করলেন কিশোরকুমার, লতা মঙ্গেশকারের গানে সুর করবেন।গান লিখবেন মুকুল দত্ত।মুকুল দত্ত লতা মঙ্গেশকরের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে জানলেন যে কিশোরকুমার এক অদ্ভুত শর্ত দিয়েছেন।সেটি হলো এই যে লতাজীকেও কিশোরকুমারের গানে সুর দিতে হবে।তবেই কিশোরকুমার সুর করবেন।কি আর করা যায় মুকুলদত্ত দুজনের গানেই কথা বসালেন। ১৯৭৪ সালের পুজোর গানে এই দুই ভারতবিখ্যাত শিল্পী একে অপরের সুরে গান গাইলেন।লতা মঙ্গেশকর কিশোরকুমারের সুরে গাইলেন ‘ প্রিয়তমা কি লিখি তোমায়’ এবং ‘ ভালোবাসার আগুন জ্বেলে ‘ অন্যদিকে কিশোরকুমার লতা মঙ্গেশকরের সুরে গাইলেন’ তারে আমি চোখে দেখিনি ‘ এবং ‘ আমি নেই আমি নেই’।
পরিচালক অসিত সেন আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের ‘চলাচল’ছবির হিন্দি ভার্সান সফর ছবির পরিচালনা করছেন।ওই ছবির গান ‘ জিন্দেগি কা সফর হ্যায় ইয়ে ক্যায়সা সফর’ গানের রেকর্ডিং চলছে।অসিত সেন দেখলেন গানের অন্তরায় গীতিকার ইন্দিবর লিখেছেন ‘ বহুত প্যার ম্যায়নে দিয়া’। পরিচালকের মনে হলো কেমন স্বার্থপর স্বার্থপর এপ্রোচ।সুরকার কল্যাণজী আনন্দজীকেও তিনি ব্যাপারটি বললেন।তাঁরাও অনুধাবন করলেন বিষয়টি।অসিত সেন বললেন যদি লেখা হয় ‘ বহুত প্যার হামনে দিয়া’ তাহলে আন্তরিক ও সার্বজনীন এপ্রোচ হবে।ইন্দিবরকে দিয়ে পরিবর্তন করানো হলো।কিশোরকুমার উল্লসিত হলেন।অসিত সেনকে প্রশংসা করতে লাগলেন।আর যেভাবে গানটা গাইলেন তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
শক্তি সামন্তর ছবি মেহবুবা।জন্মান্তরবাদ নিয়ে গল্প।আনন্দ বক্সীর কথায় রাহুল দেব বর্মণের সুরে একটি গান তৈরি হলো যা লতা মঙ্গেশকর আর কিশোরকুমার দুজনেই একবার একবার করে গাইবেন।সারা ছবিতে দুজনের গলা ফিরে ফিরে আসবে প্রথমে গানটি কিশোরকুমারকে গাইতে বলা হলো।কিন্তু তিনি নারাজ।প্র‍থমে লতাজীকে দিয়ে গাওয়াতে হবে।তারপর তিনি গানটা শুনবেন,খাবেন, গিলবেন,হজম করবেন তারপর গাইবেন।রাহুলদেব বর্মণ তাই করলেন।লতাজীর রেকর্ডিং হয়ে যাওয়ার পর কিশোর গাইলেন।সে যা গাইলেন আজও শুনে গায়ে কাঁটা দেয়।
মধ্যপ্রদেশের খান্ডোয়া ছোটো অথচ এক জমজমাট জনপদ। সেখানে থাকেন প্রসিদ্ধ আইনজীবী কুঞ্জলাল গাঙ্গুলি আর তাঁর স্ত্রী গৌরী দেবী।বাড়ির নাম গৌরীকুঞ্জ।তিন ছেলের মধ্যে ছোটোর নাম আভাস। সে ছোটোবেলা থেকেই খুব দুরন্ত।দুষ্টুমিতে তার জুড়ি মেলা ভার।তাঁরা খুব চিন্তিত এই ছেলেকে নিয়ে। বড়ো কুমুদলাল বম্বে টকিসের গায়ক নায়ক অশোককুমার।মেয়ে সতী দেবীর সঙ্গে বিয়ে হয়েছে বম্বের বিখ্যাত চলচ্চিত্র প্রযোজক ও পরিচালক শশধর মুখার্জির সঙ্গে। বাড়িতে আভাস আর তার মেজদা অনুপ। দুষ্টু হলে কি হয় আভাস গান গাইতে ওস্তাদ আর তার সঙ্গে মিমিক্রি।বাড়িতে কুঞ্জলালের বন্ধুরা এলে সে অনায়াসেই শুনিয়ে দেয় কে এল সায়গল, শচীন দেব বর্মন বা তার দাদামণি অশোককুমারের গাওয়া নানা গান।সবাই খুশি হন।তাকে দু একটাকা বখশিস দেন।তাতেই আভাসের সে কি আনন্দ।
এহেন ভাইকে অশোককুমার বম্বেতে নিয়ে এলেন।সুরকার ক্ষেমচাঁদ প্রকাশ জিদ্দি ছবির জন্য সুযোগ দিলেন আভাসকে। ততদিনে আভাসের নাম পরিবর্তন হয়ে কিশোর হয়েছে। ক্ষেমচাঁদ প্রকাশের সুরে কিশোর গাইলেন ‘ মরণ কি দুয়ায়েঁ মাঙ্গু।১৯৪৮ সালে প্রকাশিত এই গান থেকে ১৯৮৭ র ১৩ অক্টোবর। প্রায় ৪০ বছরের সাঙ্গীতিক জীবনে কয়েক হাজারের মতো গান।হিরন্ময় আধারে রাখা বর্ণোজ্জ্বল হীরকখন্ডের রংবাহারি দ্যুতির কোনটি যে বেশি মোহময় তা কেউ জানে না।শিল্পী কিশোরকুমার,গীতিকার কিশোরকুমার,সুরকারকিশোরকুমার,প্রযোজক, পরিচালক কি নন তিনি। কিন্তু মানুষটিও কম বর্ণময় ছিলেন না।বাইরে থেকে অনেকেই তাঁকে খামখেয়ালী মনে করলেও ভিতরে ভিতরে লালন করতেন একটা অনুভবী মন যে মনের পরিচয় পেয়েছেন অনেকেই।
স্বয়ং সত্যজিৎ রায় স্বীকার করেছেন তাঁর এই অনুভবী মনের কথা।বাঙালী সঙ্গীত পরিচালকদের প্রতি ছিলো দুর্বলতা। বম্বের এক নামকরা সঙ্গীত পরিচালককে দেওয়া ডেট ক্যান্সেল করে কলকাতার সঙ্গীত পরিচালক মৃণাল বন্দ্যোপাধ্যায়কে ডেট দিয়েছিলেন।
নোটেশান করতেন নিজস্ব ভঙ্গীতে। কোথাও গোল দাগ দিচ্ছেন আবার কোথাও রেফের মতো দিচ্ছেন।জিজ্ঞেস করলেই বলতেন গোলদাগ দেওয়া জায়গাটায় রাউন্ড হচ্ছে সুর। রেফ দেওয়া জায়গাটায় সুর কাটছে।
একবার মহাবলিপুরমে শ্যুটিং হচ্ছে।যে ছেলেটি রোজ চা দিতো সবাইকে তার সঙ্গে কিশোরকুমারের খুব ভাব।কথায় কথায় একদিন কিশোরকুমার জানতে পারলেন যে সে কোনোদিন প্লেনে ওঠেনি। সঙ্গে সঙ্গে কিশোরকুমার প্রযোজককে ডাকলেন।তখনই ওই ছেলেটির জন্য একটি প্লেনের টিকিট কেটে তাকে প্লেন চড়াবার আদেশ দিলেন।কিশোরের জন্য ছেলেটি প্লেনে উঠতে পারলো।
দাদামণি অশোককুমার কিশোরের থেকে ১৮ বছরের বড়ো। দাদামণিকে ভক্তি করতেন বাবার মতো তাই অশোককুমারের জন্মদিনেই চিরতরে চলে গেলেন কিশোরকুমার অশোককুমার আর কোনোদিনই নিজের জন্মদিন পালন করেন নি।
সারাজীবন আঘাত পেয়েছেন বারবার।ভুল বুঝেছেন তাঁকে নিজের লোকেরা।দুঃ সময়ে ছেড়ে গিয়েছেন অনেকেই। তাঁকে দমানোর চেষ্টা হয়েছে বারবার।কিন্তু হার মানেননি কিশোরকুমার।নিজেই গেয়েছিলেন,
” তেরি দুনিয়াসে হোকে মজবুর চলা ম্যায় বহুত দূর বহুত দূর চলা”
চলে গেছেন সুরলোকে ১৯৮৭ সালে।কিন্তু যতদিন ভারতীয় সঙ্গীত থাকবে,সমঝদার শ্রোতারা থাকবেন,ততদিন থাকবেন কিশোরকুমার।
আজ তাঁর জন্মদিনে জানাই সশ্রদ্ধ প্রণাম।

৪ আগস্ট ২০২১।

Please follow and like us:

Leave a Reply

Your email address will not be published.