“তুমি অধম তাই বলিয়া আমি উত্তম হইবো না কেন”– এই বাক্যটির সঙ্গে অল্পবিস্তর সবাই পরিচিত। পরিচিত আর বাস্তবে কাজে লাগানোর মধ্যে অনেক পার্থক্য রয়েছে। কেউ কথায় কথায় কুকথা ব্যবহারে অভ্যস্ত বলেই পাল্টা সেই ভাষাই বিপক্ষকে উত্তর দিতেই হবে এটা নিশ্চয়ই সভ্য সমাজের জন্য কাম্য নয়। রাজ্য বিজেপির কাছে পশ্চিমবঙ্গের একটা বড় অংশের প্রত্যাশা আকাশচুম্বী হয়ে গিয়েছিল। শুধু প্রয়োজন ছিল এমন একজন নেতৃত্বের, যাঁর দৃঢ় উপস্থিতি নিচু তলার কর্মিদের প্রানিত করবে, সংঘবদ্ধ শক্তিশালী করে তুলবে, শাসকদলের ঘুম কেড়ে নেবে। বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির বেহাল দশা তৈরী হওয়ার অন্যতম কারণ যোগ্য নেতৃত্বের অভাব। “বিশ্বের সবচেয়ে বড় গনতান্ত্রিক দল বিজেপি”– সুতরাং প্রতিপক্ষকে হেয় জ্ঞান করতে হবে এটা যে কতটা ভ্রান্ত ধারণা তা নিশ্চয়ই এই রাজ্যে বিজেপিকে নতুন করে বোঝাতে হবে না।
এটা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই যে লোকসভায় এই রাজ্য থেকে আঠারোটি সাংসদ নির্বাচিত হয়েছেন তার কৃতিত্ব অনেকাংশেই ছিলো মুকুল রায়ের। কিন্তু বিজেপির রাজ্য সভাপতি থাকাকালীন দিলীপ ঘোষ এই মুকুল রায়কে সেভাবে ব্যাবহারই করেন নি, এমনিতেই মুকুল রায়কে বলা হয় রাজনীতিতে চানক্য। তিনি তাঁর হাতে তৈরী তৃনমূলে চরম অসম্মানিত হওয়ার জন্য বিজেপিতে যোগ দিয়েছিলেন। যোগ দিয়েই তিনি বুঝিয়ে দিয়েছিলেন তিনি আর কেউ নন, তিনি মুকুল রায়, গড়তেও যেমন পারেন, দরকার হলে ভাঙতেও পারেন। তৃনমূলের মধ্যে ভাঙন অব্যাহত রেখেছিলেন তিনি। আই প্যাকের সাহায্য না নিলে তৃনমূলের মাথা তুলে দাঁড়ানো যে এতো সহজ হতো না সেটা নিশ্চয়ই বিজেপির বোধোগম্য হওয়া উচিত ছিল। একে একে ভাঙিছে দেউল — এটা বুঝতে চাননি অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী দিলীপ ঘোষ। তাঁর একেরপর এক আলটপকা মন্তব্য দলকে বারবার বিব্রত করেছে, তিনি সংযত হননি। মুকুল রায়কে দলে উপযুক্ত সম্মান না দেওয়া, বিধায়ক পদে প্রার্থী করে একটা এলাকায় সীমাবদ্ধ রাখা, উদ্ধত বক্তব্য, মন্তব্য, দলের ভবিষ্যত না ভেবে, নিজেদের দলের কর্মীদের প্রার্থী না করে অন্য দল থেকে বিজেপিতে যোগ দেওয়া মাত্রই যাকে খুশি দলের টিকিট ধরিয়ে দেওয়া যে কত বড় হঠকারী সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিলো সেটা নিশ্চয়ই বিজেপির কেন্দ্রীয় ও রাজ্য স্তরের নেতৃত্বরা হাড়ে হাড়ে বুঝতে পেরেছিলেন। মুকুল রায়কে অবহেলা করা দিলীপ ঘোষের প্রথম ভুল, দ্বিতীয়তঃ গত ২ মে ভোটের গননায় বিজেপির বহু কাউন্টিং এজেন্ট এর বিশ্বাসঘাতকতা নিয়ে যে সন্দেহের বাতাবরণ তৈরী হয়ে ছিলো, শাসকদলের বিরুদ্ধে গননাকে মাঝপথে থামিয়ে দেওয়ার যে ভয়ঙ্কর অভিযোগ রটে ছিলো, — যা কিছু রটে কিছু তো বটে, মনে করেও রি- কাউন্টিং এর আবেদন না করার রহস্যময় নীরবতা রাজ্য সভাপতি থাকাকালীন সময়ে দিলীপ ঘোষের বিরুদ্ধে দলীয় স্তরে নীচুতলায় একটা বড় অংশের বিজেপির কর্মিদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ তৈরী করে ছিলো। অনেকেই মনে করেছেন এই যে বিরোধী দল বিজেপির ৭৭ টি বিধায়ক পেয়েই আত্মসন্তুষ্টি, শাসকদলের কাছে অদ্ভুত এক নতিস্বীকার সাধারণ কর্মিদের পাশাপাশি ভুক্তভোগী, নির্যাতিত, নিপীড়িত, বঞ্চিত, কর্মহীন পরিবারগুলো যে মেনে নিতে পারেননি রাজ্য সভাপতি থাকাকালীন দিলীপ ঘোষ সচেতন ভাবেই বুঝতে চাননি। শতাধিক কর্মী খুন, গ্রামে গ্রামে বিজেপির কার্যকর্তাদের বাড়ি ভাঙচুর, ঘরছাড়া হওয়া, একেরপর এক মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে জেরবার অবস্থা, ভোটের ফলাফল ঘোষণা হওয়ার পর থেকেই আক্রান্ত, অসহায় কর্মিদের পাশে সে অর্থে নেতৃত্বদের না পাওয়া দলে অদৃশ্য দেয়াল তৈরী করে দিয়েছে। এরই মধ্যে বিজেপি থেকে একেরপর এক ভাঙন অব্যাহত। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ক্ষোভ, অভিযোগ, অভিমানের কেন্দ্র সেই একজনই তিনি দিলীপ ঘোষ। কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের কাছে পশ্চিমবঙ্গ বিজেপির অনেকেই ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন, অভিযোগ জানিয়েছেন, কিন্তু কেন্দ্রীয় নেতৃত্বদের ঘুম ভাঙতে খুবই দেরি হয়ে গেছে। সম্ভবত, ভবানীপুর উপনির্বাচনেও সদ্য অতিত থেকে শিক্ষা না নিয়ে চোখে চোখ রেখে, দাঁতে দাঁত চেপে সর্বশক্তি দিয়ে ভোট সন্ত্রাস প্রতিহত করার লড়াই চালিয়ে যাওয়ার মতো প্রস্তুতি সম্পন্ন করে উঠতে পারবে না এই মুহূর্তে নানা দিক থেকে বিদ্ধস্ত দুর্বল বিজেপি।
তবে গতকাল রাজ্য সভাপতি পদে বদল ঘটিয়ে ড. সুকান্ত মজুমদারকে দায়িত্ব দেওয়ায় বিজেপির অন্দরে স্বস্তির বাতাবরণ তৈরী হয়েছে। অনেকেই মনে করছেন আরো আগে এই সিদ্ধান্ত নেয়া হলে হয়তো বাবুল সুপ্রিয়কেও হারাতে হতো না। অত্যন্ত ভদ্র, মার্জিত, বিদগ্ধ ব্যাক্তি হিসেবে পরিচিত ড. সুকান্ত মজুমদার এখন কি ভাবে বঙ্গ বিজেপির ভাঙন রোধে, একই সঙ্গে সাধারণ কর্মিদের পাশাপাশি ভুক্তভোগী মানুষদের জন্য বিশ্বস্ত অভিভাবক হিসেবে নিজেকে গ্রহণ যোগ্য করে তুলতে পারেন ও দলকে আবার তার নিজের গরিমায় ফিরিয়ে আনেন সেটাই দেখার।
