২০২১ শেষ হতে যাচ্ছে, ২০২০ ও ২০২১ গোটা পৃথিবী Covid আচ্ছন্ন ছিলো। আশা করবো, ঠাকুর, মা ও স্বামীজীর অহেতুকি কৃপায় ২০২২ আমাদের সকলের কাছে আনন্দমুখর ও সুখকর হয়ে উঠবে। বর্ষশেষে কি লিখবো সেই নিয়ে একটা ভাবনা ছিলোই, লিখতে বসলে Covid, মৃত্যু মিছিল, রিলিফ ক্যাম্প এসবের কথাই উঠে আসবে, এই ২ বছরে Covid এর ফলে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে শুধু মাত্র রামকৃষ্ণ মিশনেরই ১০৩ জন সাধু দেহ রেখেছেন, তাই এই বিষন্নতা নিয়ে না লিখে এবার একটু অন্যভাবে কলম ধরলাম।লেখার বিষয় হিসেবে বেছে নিলাম নবীন প্রজন্মকে যারা আগামী পৃথিবীকে দিশা দেখাবে। কিন্তু নতুন প্রজন্ম কতটা প্রস্তুত তাই নিয়েই একটা ছোট্ট আলোকপাত করছি আজকের এই লেখায়।আসামের এক একান্নবর্তী সম্ভ্রান্ত বনেদি পরিবারে আমার জন্ম। ছোটবেলায় মাকে দেখতাম, মাছের মাথাটা সবসময় বাবার প্লেটে দিতে। খুব ছোটবেলা থেকেই বুঝতাম যে তিনি এই পরিবারের প্রথম শ্রেণীর মানুষ। তিনি যখন ঘুমাতেন, তখন আমরা উচ্চস্বরে কথা বলতাম না। তার সিদ্ধান্ত পছন্দ না হলে, তার সঙ্গে উচ্চস্বরে কথা বলার সাহস কখনই তৈরি হয়নি। আবার ঠাকুমা যখন বেড়াতে আসতেন, তখন মাকে দেখতাম বাবার কিছু কিছু সুবিধা কমিয়ে দিতে। এটুকু ধারণা মা পরিষ্কার তৈরি করে ছিলেন যে,সিনিয়ররা জুনিয়রদের চেয়ে অধিক শ্রদ্ধা ভাজন এবং অধিক সুবিধা পাওয়ার অধিকার রাখেন।এখন অবস্থা পাল্টেছে। যে কোন বাবা-মাকেই যদি জিজ্ঞাসা করা হয়, আপনার পরিবারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কে? তারা নিঃসন্দেহে বলবে, তাদের সন্তান। তাদের সন্তান সোনার টুকরো, হীরার টুকরো, প্লাটিনামের টুকরো। যদি প্রশ্ন করা হয়, কেন তারা এতটা গুরুত্বপূর্ণ, তারা এমন কি কাজ করেছে যে তারা এতটা গুরুত্ব পূর্ণ। কেউ সদুত্তর দিতে পারবে না। তারা কোন কারণ ছাড়াই, কোন যোগ্যতা অর্জন ছাড়াই কি করে প্রথম শ্রেণীর নাগরিক !আমাদের সমস্যার জায়গাটা এখানেই। কোন অফিসে যদি এমডির পরিবর্তে জুনিয়র অফিসার বেশি গুরুত্ব পায়, তাহলে ঐ অফিসের শৃঙ্খলা ভেঙে পড়বে। যদি আর্মি জেনারেলের চেয়ে তার অধীনস্থ সৈন্যরা সর্বদা বেশি গুরুত্ব পায়, তাহলে ঐ আর্মি দিয়ে যুদ্ধ জয় সম্ভব না। আমাদের সন্তানরা জ্ঞান হওয়ার কিছু পর থেকেই বুঝতে পারে, তারা পরিবারের প্রথম শ্রেণীর নাগরিক, তাদের সুযোগ সুবিধা দেখার জন্যই নিয়োগ দেওয়া হয়েছে তাদের বাবা-মাকে, যারা এই পরিবারের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক এবং তাদের দাদু- দিদিমা- ঠাকুমারা তৃতীয় শ্রেণির নাগরিক।সন্তান যখন দেখবে, সে কোন যোগ্যতা অর্জন ছাড়াই সে এই পরিবারের প্রথম শ্রেণীর নাগরিক, তখন সে এমনকি আরও পরিশ্রম করে যোগ্যতা অর্জন করতেও চাইবে না। পরিবারে বাবা-মার অবস্থান সম্পর্কে, তাদের সুযোগ সুবিধা সম্পর্কে ভুল ধারণা তৈরি হবে। দাদু- ঠাকুমার সঙ্গে, দাদু- দিদিমার সঙ্গে কিভাবে কথা বলতে হয়, এগুলো শিখবে না। সমাজের বয়োজ্যেষ্ঠদের সঙ্গে কিভাবে কথা বলতে হয় শিখবে না, কারণ সেতো জন্মগতভাবে প্রথম শ্রেণীর সুবিধাভোগী নাগরিক। এখন মাঝে মাঝেই শোনা যায়, সন্তান মা-বাবার সঙ্গে জেদ করছে, তাকে কেন দামী মোবাইল ফোন কিনে দেওয়া হচ্ছে না, দামী ল্যাপটপ কিনে দেওয়া হচ্ছে না। এমনকি কোন বাড়িতে যাওয়া হবে, কোথায় যাওয়া যাবেনা, কার সাথে কথা বলা যাবে, কার সাথে যাবেনা, কোন ব্রান্ডের জিনিস কেনা হবে, কি কি খাওয়া উচিৎ বা কি কি উচিৎ নয়, সবকিছুই নাবালক সন্তানরাই আজ নির্ধারণ করে দিচ্ছে। তারা এরকম করবে এটাই স্বাভাবিক, কারণ তারা এটা জেনে বা দেখে বড় হচ্ছে যে – তাদের সুবিধা দেওয়াই তাদের বাবা-মার দায়িত্ব। তারা কিভাবে তাদের দায়িত্ব পালন করবে এটা তাদের ব্যাপার। বাবা-মা এখন আর চায় না যে তাদের সন্তান একজন দায়িত্বশীল নাগরিক হোক। বাবা-মা তাদের সন্তানদের তাদের সামাজিক অবস্থান সম্পর্কে কখনই জানান না, সামাজিক দায়বদ্ধতা সম্পর্কে কখনো কিছু বলেন না। শুধু বলেন, বেটা/মা তোকে IAS/IPS ক্যাডার হতে হবে, ডাক্তার/ ইন্জিনিয়ার হতে হবে। কতজন বাবা-মা আছে যে তাদের সন্তানদের বলে, বাবা/মা তোরা শিক্ষিত দ্বায়িত্বশীল মানুষ হ ! সামাজিক দায়িত্ববোধ শূন্য, সামাজিক সম্পর্ক শূন্য এইসব ছেলেমেয়েরা সমাজকে এবং আমাদের সংস্কৃতিকে কিভাবে উপরে তুলবে? এরা বরং যে কোন সময় সুবিধাজনক প্লাটফর্মে নিজেদেরকে শোষিত হতে দিতে অহংকার করবে। কোনটা লজ্জা বোধের আর কোনটা অহংকারের বিষয় – পার্থক্য তৈরি করতে পারবে না। এর ফলে রেজাল্ট হচ্ছে – এই সন্তানরা তৈরী হচ্ছে একটা আস্ত গাধা, একটাও আর মানুষের মত মানুষ হচ্ছে না। স্বামীজী বলেছিলেন, মনুষ্য জীবনের উদ্দেশ্য হলো মনুষ্যত্ব থেকে দেবত্বে উন্নীত হওয়া, দেবত্ব দূরে থাক, এরা একটাও দ্বায়িত্বশীল মানুষ হয়েই উঠছে না, কারণ বাবা মায়ের প্রশ্রয় এবং তাদের অহেতুক প্রথম শ্রেণীর মর্যাদা প্রদান করা। এর ফলে বাবা মায়েরা দায়িত্ব নিয়ে সন্তানদের অতল অন্ধকারে নিমজ্জিত করে দিচ্ছে।বাবা-মার প্রাথমিক দায়িত্ব সন্তানকে IAS/IPS/ডাক্তার/ ইঞ্জিনিয়ার/WBCS বা ঘুষখোর বানানো নয়। বাবা-মার প্রাথমিক দায়িত্ব সন্তানকে একজন মজবুত দায়িত্বশীল নাগরিক হিসাবে গড়ে তোলা।নতুন বছরে প্রত্যেক বাবা মায়ের কাছে একটাই আবেদন, সন্তানকে আদৰ্শ দিন, বৈভব নয়; সংস্কার দিন, অহংকার নয়; আপনার সন্তান হয়ে উঠুক আগামী পৃথিবীর পথপ্রদর্শক।২০২২এ সবাই ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন, আনন্দে থাকুন ঠাকুর – মা – স্বামীজীর কাছে এই প্রার্থনা করি।