সময়ের প্রবাহমান ধারায় পার হয়ে গেল ১৪২৮ বঙ্গাব্দ। সূচনা হলো ১৪২৯ বঙ্গাব্দের । কিন্তু আধুনিক সভ্যতার এই যুগে পৃথিবী যখন ঘরের মধ্যে খেলা করে টেলিভিশনের পর্দায়, তখন বিশ্বমাঝে মাতৃভাষার জন্য অনন্য দৃষ্ঠান্ত স্থপানকারী গর্বিত বাঙালি হয়ে বাংলা নববর্ষ দুইদিন দুই বাংলায় পালন নিয়ে দ্বিধান্বিত হই। নব প্রজন্মের কাছে বিভ্রান্তের উত্তর দিতে হয়। কোনটা সত্যি? কারা সঠিক? আমরা কি পারিনা দুই বাংলার পন্ডিতগণ মিলে বাংলা বর্ষের বিভ্রান্তি দূর করে নববর্ষ (বর্ষবরণ) ৮ই ফাল্গুন, ২৫শে বৈশাখ, ১১ জ্যৈষ্ট, ২২শে শ্রাবণ সহ বাঙালি ঐতিহ্যমন্ডিত সকল স্মরণীয় দিবসগুলি একত্রে পালন করতে?
প্রাচীন ইতিহাসদৃষ্টে দেখা যায় ভারত উপমহাদেশে বাঙালি অধ্যুষিত এলাকায় তৎকালীন সম্রাট, রাজ-রাজাগণ রাজ্য পরিচালনা ও খাজনাদী আদায়ের মাধ্যমে রাজা-প্রজাদের সম্পর্কের ধারাবাহিকতা রক্ষার্থে সম্রাট আকবর তাঁর রাজসভার পন্ডিতবর্গের মাধ্যমে ফসলী সন বা বাংলা সনের প্রবর্তন করেন। সেই ৪৫৭ বছর আগে হিজরী সনকে সৌরবর্ষ চালু হওয়া বাংলা নববর্ষ আজ সকল বাংলা ভাষাভাষী বা বাঙালি জাতির কাছে বঙ্গাব্দ অথবা বাংলা বর্ষপঞ্জী হিসেবে পরিচিত।
প্রাচীন আমলের অনেক সৃষ্টিই শুধু নয় ধর্মীয় নীতিমালাও যুগ সন্ধিক্ষণে সময়ের দাবীতে পরিবর্তন/পরিবর্ধণ/ সংশোধন/ বিয়োজন হয়ে মানব জাতির কল্যাণে সভ্য সমাজের উপযোগী রূপে নব রূপায়ন করা হয়েছে। মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। জগতের সব কিছুই মানবের কল্যাণে সৃষ্টি হয়েছে। ধর্ম, সমাজ-সংস্কার, নীতিমালা ইত্যাদি সবই পৃথিবীতে মানব জাতিকে সুষ্ঠু ও সুস্থ-সুন্দরভাবে পরিচালনা করার লক্ষ্যে সৃষ্ট হয়েছে। পুরানো দিনের অনেক ধর্মীয় নীতিমালা বর্তমান সময়ে বাতিল করে সংশোধিত মানব কল্যাণকর নীতিমালা করা হয়েছে। তৎকালীন সম্রাট/ রাজাদের রাজ্য পরিচালনার নীতি-কৌশলও আজ যুগের কাছে মূল্যহীন হয়ে নতুন পদ্ধতি প্রণয়ন করা হয়েছে। ঠিক তেমনি বাংলা বর্ষপঞ্জীর বিভ্রান্তকর অযৌক্তিক একটি প্রাচীন সূত্রকে সংশোধন করার জন্য বাংলাদেশ সরকার সাহিত্যের দিকপাল ডঃ মুহম্মদ শহিদুল্লাহ সহ ৬জন বরেণ্য সাহিত্য বিশারদকে দিয়ে গঠনমূলক বিজ্ঞান সম্মত সঠিক বাংলা বর্ষ পঞ্জিকা প্রণয়নের উদ্যোগ নিয়ে তা যথার্থ বাস্তবায়ন করেন। আমরা দল মত, জাতি ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সবচেয়ে বড় পরিচয় বিশ্বমাঝে গর্বিত বাঙালি। সেই বাঙালির প্রাচীন ঐতিহ্য-কৃষ্টিকে অক্ষুন্ন রেখে একসাথে একই দিনে প্রাণের টানে বাঙালি মিলনমেলার মাধ্যমে যার যার অবস্থানে থেকেও আনন্দঘন পরিবেশে স্মরণীয়-বরণীয় দিনগুলিকে উপভোগ করতে পারি। সেক্ষেত্রে কাঁটাতারের বেড়া কিংবা সীমানার দূরত্ব কোন বাঁধাই নয় আজকের ডিজিটাল সভ্যতার যুগে। অথচ ভারতের পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য সরকার আজও বিভ্রান্তকর অযৌক্তিক একটি প্রাচীন সূত্রকে আকড়ে ধরে রেখে বাঙালিদের মধ্যে বাংলা বর্ষপঞ্জীর বিভেদ সৃষ্টি করে রেখেছেন। দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক- রাজনৈতিক অনেক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়ে সমঝোতায় পরিচালিত হলেও বাঙালিদের এই অস্তিত্ববাহী দিনগুলিকে বিভ্রান্তকারী বাংলা বর্ষপঞ্জীর বিভ্রাটকে সুষ্ঠু-সুস্থ চিন্তাভাবনা দিয়ে পরিবর্তণের কোন উদ্যোগ কোন সরকার কিংবা রাজনৈতিক দল অথবা তাদের দ্বা পরিচালিত নীতি নির্ধারক, বুদ্ধিজীবী, শিক্ষাবিদ কারোরই মাথা ব্যথা নেই। অপরদিকে লৌকিকতা প্রর্দশনের জন্য সকল অনুষ্ঠানই আমরা দু’দেশেই স্বেচ্ছাচারিভাবে লালন করছি-পালন করছি। বাংলাদেশেও ঐ সকল ধর্মীয় বরণীয় দিবসগুলি বর্ষপঞ্জীর বিভ্রাটের কারণে দুই দিনে পালন করছে অনেকেই। এ কোন বাঙালি প্রেম? মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, সংস্কৃতি মন্ত্রী সহ সংশ্লিষ্ট সকল মহলের কাছে আমাদের প্রাণের দাবি বাঙালি সত্বাকে দ্বিখন্ডিত না করে বিষয়টিকে গুরুত্বসহকারে সমাধানের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ ও বাস্তবায়নে আন্তরিক হোন।
আমাদের জন্য অত্যন্ত দুঃখের বিষয় যে পৃথিবীতে বৃহৎ পরিসরে বাঙালির বসবাস শুধুমাত্র বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গে। বাংলা বর্ষপঞ্জীর মূল্যায়ন যথার্থভাবে বাঙালিরাই পালন করে। অথচ প্রাচীনকালের বর্ষপঞ্জীর বিভ্রান্ত বাংলাদেশ সরকার সংশোধন করলেও পশ্চিমবঙ্গের রাষ্ট্রপ্রধান তথা সচেতন বাঙালিদের গঠনমূলক পদক্ষেপ না থাকায় দু’দেশের বাঙালিরা বাংলা নববর্ষকে দুইদিনে পালন করে। এ নিয়ে প্রবাসী বাঙালিরা বিভ্রান্তে পরে। বাংলা পঞ্জিকাতেও দুইভাবে তারিখ বর্ণনা করা হয়, যার প্রেক্ষিতে বাংলাদেশের বিশেষত হিন্দু সম্প্রদায় প্রাচীণকালের নীতি অনুযায়ী (বর্তমান ভারতের পশ্চিমবঙ্গে প্রচলিত) বাংলা বর্ষপঞ্জীর অনুকরণে নববর্ষ সহ অন্যান্য ধর্মীয় উৎসব পালন করে থাকে। আকাশ চ্যানেলের বদৌলতে টেলিভিশনের পর্দায় বাংলাদেশ ও ভারতের বাংলা চ্যানেলের অনুষ্ঠানগুলি আমরা সবাই দেখতে পাই। সেখানেও বাংলা সাহিত্যের দিকপালদের জন্ম-মৃত্যু দিবসগুলি বিতর্কীতভাবে উদযাপন করা হয়। এ অবস্থার পরিবর্তন-সংস্কার না হলে আমাদের আগামী প্রজন্ম বিভ্রান্তের শিকার হয়ে থাকবে। সেখানেও বাংলা সাহিত্যের দিকপালদের জন্ম-মৃত্যু দিবসগুলি বিতর্কীতভাবে উদযাপন করা হয়। এ অবস্থার পরিবর্তন-সংস্কার না হলে আমাদের আগামী প্রজন্ম বিভ্রান্তের শিকার হয়ে থাকবে ।
বাংলাদেশে ১৪ এপ্রিল থেকে এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গে (বাংলাদেশের হিসাবে) ১৫ এপ্রিল থেকে শুরু হয় বাংলা ১৪২৯ সনের গননা। যার প্রেক্ষিতে সারা বছর বাংলা সাহিত্যের অমর প্রয়াতদের জন্ম মৃত্যু দিবসগুলিও একইভাবে বিতকৃত থেকে যাচ্ছে। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল. জীবননান্দ, মাইকেল মধুসুদন দত্ত সহ এমন অনেক প্রতিভাবান বাঙালি অমর ব্যক্তিত্ব যাঁদের রচনা আমাদের পাঠ্যপুস্তকে পাঠ করে শিক্ষিত হয়ে জীবন জীবিকা অতিবাহিত করছি, তাদের প্রতি স্মরণীয় দিবসে শ্রদ্ধাঞ্জলি জানাতেও বিভ্রান্ত সৃষ্টি হোক তা আমাদের কখনই কাম্য হতে পারেনা। যারা পুরানা নিয়ম মেনে শ্রদ্ধা করেন তাদের জ্ঞাতার্থে জানাচ্ছি যে বাংলা ১৪২৯ নববর্ষ নয় প্রকৃত পক্ষে বাংলা সন পদার্পন করলো ৪৫৭ বছরে, এ হিসাবে বয়সের পার্থক্য থাকবে ১৪২৯- ৪৫৭=৯৭২ বছর। চিরদিন থাকবে এই পার্থক্য ? পার্থক্যের কারণ ঐতিহাসিক, যার মূল কারণ দেখা যায় বাংলা সনের জন্ম হয়েছিল ৯৬৩ বছর অগ্রীম বয়স নিয়েই।
মুসলমান বিজেতা কর্ত্তৃক বাংলা জয়ের আগে মুলত: এদেশে শকাব্দ ছিল। খ্রিষ্টিয় ১২০০ সালে ইখতিয়ার উদ্দীন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজী কর্ত্তৃক বাংলা জয়ের পর বিজেতা শাসকের কৃষ্টি ঐতিহ্য ও ধর্মীয় দিন তারিখ হিসাবের ক্ষেত্রে ব্যবহার হতে থাকে। স্বল্প পরিসরে এ ব্যাপারে আমি বিশদ আলোচনায় যাব না। সংক্ষেপে শুধু এটুকু বলবো তখনও সময়ের দাবীতে তৎকালীন রাজ্য শাসকগণ শকাব্দ পরিবর্তন করে জন কল্যাণে বঙ্গাব্দ নীতিমালা প্রবর্তন করেছিল। তাহলে আজ আধুনিক সভ্যতার যুগে ৩২ দিনে মাস গণণা না করে বাংলাদেশের হিসেবেই শুধু নয় বাংলা সাহিত্যের দিকপালদের গবেষণালব্ধ নীতিমালা অনুসরণ করে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তথা বাংলা সাহিত্যের পন্ডিতবর্গ ও বাংলা আকাদেমীর যৌথ উদ্যোগে প্রতিবেশী তথা বন্ধু রাষ্ট্রই শুধু নয় বিশ্বমাঝে সুপরিচিত বাঙালি জাতি হিসেবে বাংলা বর্ষপঞ্জীর এই বিভান্তি দূর করা সময়ের দাবীতে অতীব জরুরী হয়ে পড়েছে।
১৯৪৭ সালে বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠার দাবীতে যে মাতৃভাষার আন্দোলন সূচনা হয়েছিল পরবর্তীতে ১৯৪৮ থেকে ১৯৫২ পর্যন্ত মাতৃভাষা বাংলা প্রতিষ্ঠার জন্য যারা আন্দোলন সংগ্রাম চালিয়েছিল তাদের মধ্যে বর্তমান বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের পার্থক্য ছিলনা। তাদের একমাত্র পরিচয়/ দাবী ছিল “আমরা বাঙালি, বাংলা আমাদের মায়ের ভাষা, মাতৃভাষাকে জীবন দিয়ে হলেও প্রতিষ্ঠা করবো।” তারই সুবাদে বাঙালির জোরালো আন্দোলনে বাধ্য হয়েছিল দাবী মানতে। সেই সব ভাষা সৈনিক দেশ বিভাগের পর অনেকেই ভারতে আবাস গড়েছেন। সম্মিলিত প্রয়াসের ফসল বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠা। অথচ সেই সব বাঙালি ও তাদের উত্তরসুরী আজ বাংলা বর্ষপঞ্জীর বিভ্রান্তর শিকার।
বিশ্বমাঝে বাঙালিদের মাতৃভাষা বাংলার আন্দোলন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের সম্মান ও স্বীকৃতি পেয়েছে। সেই বাঙালিকে বিতর্কীত অবস্থায় না রেখে বাংলাদেশের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে ভারতের বাঙালি মাননীয় রাষ্ট্রপতি প্রণব মূখার্জির সহায়তায় পশ্চিমবঙ্গ সরকারের গঠনমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলা বর্ষপঞ্জীকা সংশোধন করে স্মরণীয়-বরণীয় দিনগুলি মিলে মিশে বাঙালিরা সম্মিলিতভাবে আমাদের বাঙালি ঐতিহ্যকে একই দিনে প্রাণের উৎসবে ভরে তুলি।
লেখক: কবি, গল্পকার ও প্রাবন্ধিক, সদস্য, বাংলা একাডেমী, মহাসচিব, উত্তর বাঙলা সংস্কৃতি পরিষদ, কেন্দ্রীয় কার্যালয়, পাবনা।