Arambagh Times
কাউকে ছাড়ে না

১৯৪৭ সালের ১৪ আগষ্ট পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের জন্ম হয়। তখন পাকিস্তান দুটি অংশে বিভক্ত ছিল। একটার নাম ছিল পশ্চিম পাকিস্তান এবং অপরটির নাম ছিল পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমান বাংলাদেশ)। এই দুটি এলাকার দূরত্ব ছিল বারশত মাইল। এই সময় পাকিস্তানের লোকসংখ্যার শতকরা ৫৬ ভাগ বসবাস করত পূর্ব পাকিস্তানে। আর বাকি ৪৪ ভাগ বাস করত পশ্চিম পাকিস্তানে। পূর্ব পাকিস্তানের সমগ্র জনগোষ্ঠির মাতৃভাষা ছিল বাংলা, আর পশ্চিম পাকিস্তানের জনগোষ্ঠির ভাষা ছিল মিশ্রণ। এই প্রেক্ষাপটে পাকিস্তান সংবিধান প্রণয়নের জন্য বিভ্রান্তের সৃষ্টি হয়। কারণ রাষ্ট্রভাষা সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত না হলে সংবিধান প্রণয়ন করা সম্ভব হয় না।
১৯৪৮ সালের মার্চ মাসে পাকিস্তানের প্রথম গভর্ণর জেনারেল কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ পূর্ব পাকিস্তানে সফরে এলেন। এখানে এসে ৩১ মার্চ ১৯৪৮ প্রকাশ্য জনসভায় ঘোষণা করলেন উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। এই সময় ১৯৪৮ সালে ছাত্ররা তীব্র প্রতিবাদ করে উঠলো, সেই থেকেই ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত। ১৯৪৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ইন্তেকাল করেন, ফলে খাজা নাজিমউদ্দিন নতুন গভর্ণর নিযুক্ত হন। ১৯৪৯ সাল নাগাদ পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নবাবজাদা লিয়াকত আলী খান সংবিধান প্রণয়নের লক্ষ্যে রাষ্ট্রভাষা সহ অন্যান্য অমিমাংসিত বিষয়গুলোর চুড়ান্ত ফয়সালা করতে আগ্রহী হন। ১৯৫১ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর রাওয়ালপিন্ডির শহীদবাগে এক জনসভায় ভাষণদানকালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান আততায়ীর গুলিতে নিহত হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিন রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নটি মিমাংসা করতে উদ্বিগ্ন হন।
১৯৫২ সালের ২৬ জানুয়ারি ঢাকা পল্টন ময়দানে মুসলিম লীগের এক জনসভায় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিন ঘোষণা করলেন- একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। ইতোমধ্যেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলে এবং কলেজগুলোতে পৃথক পৃথক সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়েছিল, প্রধানমন্ত্রীর এই ভাষণে সচেতন ছাত্র সমাজ বিদ্রোহ ঘোষণা করে, সেই থেকে সংগ্রাম পরিষদের আন্দোলন আরও বেগবান হয়ে উঠলো।
১৯৫২ সালে ৩১ জানুয়ারি ঢাকা বার লাইব্রেরী হলে মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর সভাপতিত্বে বিরোধী দলীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত সম্মেলনে মাওলানা ভাসানীকে চেয়ারম্যান নির্বাচিত করে গঠিত হয় সর্বদলীয রাষ্ট্রভাষা কর্ম পরিষদ। উল্লেখ্য যে, সেদিন বিরাজমান পরিস্থিতি এমন ছিল যে সম্মেলনে যোগদানকারী এক শ্রেণীর নেতৃবৃন্দের তীব্র বিরোধিতার দরুণ কমিটির নামকরণের সময় সংগ্রাম শব্দটি বাদ দিয়ে কর্ম শব্দটি গ্রহণ করতে হয়েছিল। এই দিনে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্ম পরিষদের প্রথম বৈঠকে আগামী ২১শে ফেব্র“য়ারি প্রদেশব্যাপী ভাষা দিবস আহ্বান জানানো হয়। এই কর্মসূচীর মধ্যে ছিল একুশে ফেব্র“য়ারিতে ধর্মঘট, জনমত ও শোভাযাত্রা। অবশ্য একুশে ফেব্র“য়ারি দিনটিকে ভাষা দিবস হিসাবে ঘোষণা দেওয়ার পিছনে দুইটি ইতিহাস ছিল। তৎকালীন পরিবেশে বাংলা ভাষা আন্দোলন ছিল ছাত্রদের জন্য জীবন মরণের প্রশ্ন। সেখানে রাজনৈতিক দলগুলো দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভুগছিল।
সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্ম পরিষদের কর্মসূচী প্রচারের পর তৎকালীন সরকার মরিয়া হয়ে উঠলেন। ১৯৫২ সালের ২০শে ফেব্র“য়ারি বেলা ৩টায় আংশিকভাবে ঢাকা শহরে অনির্দিষ্টকালের জন্য ১৪৪ ধারা জারি করলেন। ২০ ফেব্র“য়ারি গভীর রাতে ফজলুল হক হলের পুকুর পাড়ে মুষ্টিমেয় ছাত্র নেতাদের এক গোপন বৈঠকে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হলো যে, যেভাবেই হোক না কেন একুশে ফেব্র“য়ারিতে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করতেই হবে। যথারীতি ২১ ফেব্র“য়ারি ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ছাত্র জমায়েত ও মিছিলের প্রস্তুতি নিলে মুসলিমলীগ সরকার মিছিলকারী ছাত্রদের উপর তুমুল গুলিবর্ষণ করেন। সে সময় সালাম, রফিক, বরকত ও জব্বার নামক কয়েকজন ছাত্রসহ নাম না জানা অনেকেই গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। এর পর পরই পূর্ব বাংলার বাঙালি বুদ্ধিজীবি সমাজ হত্যাকান্ডের তীব্র প্রতিবাদ জানায় এবং ভাষা আন্দোলনের সমর্থনে এগিয়ে আসেন। এই সময় বাংলা ভাষার সমর্থনে কিছু রাজনীতিবীদ, শিক্ষক ও বুদ্ধিজীবিকে মুসলিমলীগ সরকার গ্রেফতার করার পরবর্তীকালে এদের ভাষা আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারী ব্যক্তিত্ব হিসাবে চিহ্নিত করার চেষ্টা করা হয়।
১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্র“য়ারি একটি সুন্দর সূর্য উদয়ের সূচনা। একটি ব্যথাময় ইতিহাসের পটভূমিকা। সে সূচনার পটভূমিকায় দাঁড়িয়ে সালাম, রফিক, জব্বার, বরকত, এমনি আরো নাম না জানা অগণিত ব্যক্তি আত্মোৎসর্গ করে গেছে ওদের মূল্যবান জীবন। মায়ের ভাষার স্বীকৃতির জন্য, বাংলাদেশের জন্য। রক্তের স্রোত বয়েছিল সেদিন এই বাংলার বুকে। এমনি ২১ আসে যায় শহিদী আতœার স্মৃতি হয়ে রক্তঝরা ফাগুনের সাথে মিতালী করে। আমরা কিন্তু বসে ছিলাম না। অমর আতœার রক্তের পিচ্ছিল পথ ধরেই সুন্দরের সৈকত অবগাহন করার জন্য অধিকার আদায়ের জন্য পায়ে পায়ে এগুতে লাগলাম। সেদিন ছিল একটা বিদ্রোহের আগুনের পিণ্ড প্রতিটি বাঙালির মনে। দাউ দাউ করে জ্বলছিল সে আগুন দাবানলের মত। মায়ের মধুর ভাষায় কথা বলার জন্যও শোষিতের শৃংখল। ঘটনা প্রবাহে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী নিজেদেরকে বাঙালি জাতির চেয়ে শ্রেষ্ঠ জাতি এবং বাংলা ভাষার চেয়ে উর্দুকে শ্রেষ্ঠ ভাষা হিসেবে মনে করায় সংখ্যাগরিষ্ঠ লোকের ভাষা বাংলা হওয়া সত্বেও উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা করার অপপ্রয়াস চালায়। তার ফলে বাংলার সচেতন মানুষ, সোনার ছেলেরা সেই অন্যায় ও জুলুমের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছিল সম্মিলিতভাবে এবং ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্র“য়ারি বুকের তাজা রক্ত ঢেলে বাংলা ভাষার মর্যাদাকে প্রতিষ্ঠিত করেছিল। আর মায়ের ভাষার স্বীকৃতি দানে নিজের জীবন দিয়ে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করে রেখে গেছে অধিকার আদায়ের প্রেরণা। সেই প্রেরণার অনুসরণ করেই বুলেটের আঘাতে জর্জরিত হয়ে রক্ত পিচ্ছিল পথ পেরিয়ে ৫৪ বছর ধরে আজকের এই স্বাধীনতা এবং স্বাধীন দেশে ২১শে ফেব্র“য়ারি পালন করছি বাংলাদেশে ৪৫ বছর ধরে। এমনি করে কালের কপোলতলে গড়িয়ে গেছে রক্ত পিচ্ছিল পথগুলো। সামনে আসছে নতুন দিন।
সর্বোপরি পরিলক্ষিত হয় ১৯৪৮ সাল থেকে ১৯৫২ সালের মধ্যবর্তী সময়কালে বুদ্ধিজীবি সমাজ হিসাবে যারা পরিচিত ছিল তারা অধিকাংশই তৎকালীন মেধাবী ছাত্র। তাদের অবদান এবং জীবনের বিনিময়ে আন্দোলনের উৎপত্তি হয়। ১৯৫২ সালের ৫ এপ্রিল পাকিস্তানের করাচীতে গণপরিষদের অধিবেশনে এম, আব্দুল হামিদ রাষ্ট্র ভাষা বাংলার পক্ষে জোড়ালো বক্তব্য উপস্থাপন করেন। ঐদিন গণপরিষদ অধিবেশনে বক্তব্য প্রদান করার পরেই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। এরপর তাঁকে করাচীর জিন্নাহ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে জোড়ালো বক্তব্য প্রদান করায় তৎকালীন সরকার তাঁর প্রতি রুষ্ট হন। বিভিন্ন সুত্রে জানা যায় তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের প্রছন্ন ইঙ্গিতে ডাক্তার এবং নার্স তাঁর চিকিৎসার ব্যাপারে অবহেলা প্রদর্শন করেন। এরই এক পর্যায়ে ১৯৫২ সালের ৮ এপ্রিল ভোররাতে করাচী জিন্নাহ হাসপাতালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। পরবর্তীতে পাকিস্তান সরকার তাঁর পরিবারের অনুমতি না নিয়েই ঐদিন বিকালে করাচীতে তাঁকে সমাহিত করেন।

পাকিস্তান সরকারের বাঙালি জাতির পরাধীনতার বিষয় টি আমরা অনেকেই জানি। আমাদের মাতৃভাষা বাংলাকে পদাঘাত করে উর্দুকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা করবার বিরুদ্ধে সচেতন বাঙালিরা আন্দোলন -সংগ্রাম করে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বাঙালির জীবনে ঐতিহাসিক প্রাণের দাবি বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি আদায় করেছিল। সেকথা আজ আমরা সবাই জানি ও প্রতিবছর পালন করি নানান আয়োজনে।
প্রসঙ্গক্রমে আমরা প্রায়শই দুই বাংলা কথাটি বার বার বাঙালি শিল্প সংস্কৃতি ক্ষেত্রে ব্যবহার করি। সেক্ষত্রে ভারতের পশ্চিম বাংলা আর বাংলাদেশ বুঝাই। কিন্তু যাতায়াত যোগাযোগ নিয়মিত না থাকায় অনেকেই আসাম ত্রিপুরা রাজ্যের বাংলা ভাষার বাঙালি সংস্কৃতির ইতিহাস জানিনা বিধায় ঐ রাজ্যের সাথে অনেকেই অপরিচিত। আমি মাতৃভাষা প্রনাম দিবসে বাংলাদেশের পক্ষে সরকারি আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে গত ১৯৯৭ সালে ত্রিপুরা রাজ্যের ধর্মনগরে সরকারি অনুষ্ঠানে যোগদানের মাধ্যমে জীবনের নব দিগন্তের সন্ধান পেয়েছি। শিক্ষা ও সংস্কৃতি মন্ত্রী প্রধান অতিথি আমি সহ কয়েজন বিশেষ অতিথি ছিলাম। মাতৃভাষা সম্মাননাও পেয়েছিলাম সম্মানী সহ। যেখানে সম্পূর্ণ ষোলআনা নিখাদ বাঙালি সংস্কৃতির চর্চা হয়। তাদের শ্লোগান ছিল নিজের ভাষাকে ভালবাসবো অন্য ভাষাকে শ্রদ্ধা জানাবো। এত সুন্দর বাঙালি সংস্কৃতির অনুষ্ঠান পশ্চিম বাংলা ও বাংলাদেশের অন্য সব অনুুষ্ঠানেও নজরে পড়েনি। যারা চট্টগ্রাম, সিলেট, মৌলভীবাজার এলাকায় শিল্প সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িত তারা মাঝে মধ্যেই তাদের অনুষ্ঠানে যোগদানের মাধ্যমে দেখেছেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য ওরা আজও আমাদের অনেকের কাছে অজানাই রয়ে গেছে।
বাংলাদেশের বাঙালিরা শুধু ২১ শে ফেব্র“য়ারি পালন করি। কিন্তু মাতৃভাষা বাংলাকে প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯৪৭ সাল থেকে অখন্ড ভারতবর্ষের বাঙালিদের মাঝে আন্দোলন সংগ্রাম দানা বেঁধেছিল। পরবর্তীতে বৃটিশ সরকার সুকৌশলে ভারত উপমহাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রেক্ষিতে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত (হিন্দুস্থান) ও পাকিস্তান নামক দুটি রাস্ট্রের স্বাধীনতা প্রদান করেন। কিন্তু বাঙালি জনগোষ্টীর মাতৃভাষা অর্জনের দাবি আদায়ের আন্দোলন চলতেই থাকে। যার ফলশ্র“তিতে ১৯৫২ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ও পরবর্তীতে ১৯৬১ সালে ভারতের আসাম ত্রিপুরা রাজ্যে ১৯ মে মাতৃভাষা আন্দোলন সফল ও স্বার্থক হয়েছিল। আসামের শিলচরে ১৯৬১ সালে যে ১১ জন শহীদ আত্মবলিদান দিয়েছিল তাদেরকে আমরা স্মরণ করিনা। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মাঝেও শ্রদ্ধা জানাই না। ১৯ মে তো পালনই করিনা। কিন্তু সবার জ্ঞাতার্থে ছোট্ট পরিসরে আজ আমি সেই ইতিহাস প্রকৃৃত বাঙালি সংস্কৃতির ধারক বাহকদের তথা সমগ্র বাঙালিদের উদেশ্যে তুুলেৃ ধরছি।

আমাদের প্রতিটি বাঙালি দেশপ্রমিক ও মাতৃভাষা অনুরাগী বাঙালিদের অবশ্যই কর্তব্য এবং দায়িত্ব ২১ ফেব্র“য়ারির মত ১৯ মে বাংলা ভাষার জন্য আত্মবলিদান কৃত ১১ জন বাঙালির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করে শহীদদের প্রতি যথাযথভাবে সম্মান ও তাদের আত্ম ত্যাগের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা। সেই সাথে অনুরোধ জানাই যারা এখনও ত্রিপুরা বা আাসাম বেড়াতে জাননি তারা একবার হলেও ঘুরে সচক্ষে অবলোকন করে আসুন। দেখবেন দৃষ্টি ভঙ্গি বদলে আপনার শ্রদ্ধা বোধ বেড়ে যাবে। পরীক্ষা প্রার্থনীয়।।
সামনেই মহান উনিশে মে, ৬২তম মাতৃভাষা প্রণাম দিবস বা ঐতিহাসিক ভাষা দিবস । বাংলা ভাষার জন্য আত্মবলিদান দিবস বা বাংলা ভাষা শহীদ দিবস । আজ থেকে বাষট্টি বছর আগে রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষে উনিশশো একষট্টি সালের উনিশে মে ভারতের অসম রাজ্যের বরাক উপত্যকার শিলচরে বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষা করতে গিয়ে এগারো জন দেশপ্রেমিক বাঙালি যুবক যুবতী পুলিশের গুলিতে শহীদের মৃত্যু বরণ করে ছিলেন । এর মধ্যে মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী ষোলো বছরের কমলা ভট্টাচার্যও ছিলেন । যিনি পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম মহিলা ভাষা শহীদ। এছাড়াও যাঁরা সেদিন মহান একুশে ফেব্র“য়ারির চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে মাতৃভাষা বাংলাকে রক্ষা করার জন্য বুকের সবটুকু রক্ত শিলচর রেল স্টেশন চত্বরে রাজপথে ঢেলে দিয়েছিলেন তাঁরা হলেন চণ্ডীচরণ সূত্রধর, শচীন্দ্র চন্দ্র পাল, সুনীল কুমার সরকার, বীরেন্দ্র সূত্রধর, কানাইলাল নিয়োগী, সুকোমল পুরকায়স্থ, সত্যেন্দ্র দেব, হীতেশ বিশ্বাস, কুমুদ রন্জন দাস, এবং তরণী দেবনাথ। এই এগারোজন ভাষা শহীদের মধ্যে নয় জনেরই জন্ম তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের হবিগঞ্জ, সিলেট, মৌলভীবাজার, ময়মনসিংহ এবং ঢাকায় । অত্যন্ত দুঃখের বিষয় বাংলাদেশে রফিক, সালাম বরক, জব্বার, অলিউল্লাহ এই ৫জন ভাষা শহীদের নাম সবাই জানলেও আজও সকল ভাষা শহীদদের নাম সঠিকভাবে তালিকাভূক্ত হয়নি। মাতৃভাষা ইনষ্টিটিউট স্থাপিত হয়েছে কিন্তু ভাষা শহীদদের সুষ্ঠু তালিকা প্রণয়ণ করে পাঠ্যপুস্তকে শিশু কিশোরদের জ্ঞাতার্থে সেগুলো পাঠদানের সঠিক উদ্যোগ আজও গ্রহণ করা হয়নি। বিষয়টি গুরুত্বসহকারে আগামীতে কার্যকর করার দাবী জানাই বর্তমান সরকারের কাছে।

২১শে ফেব্র“য়ারির ভাষা আন্দোলন থেকেই পরিবেশ ও পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন শুরু হয়। অতঃপর ৬৯’এর গণঅভ্যুত্থান, ৭০’এর নির্বাচন থেকেই ৭১’এর ৭ই মার্চ ঐতিহাসিক ভাষণের মাধ্যমে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়। দীর্ঘ নয়মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর অনেক ত্যাগের বিনিময়ে আমরা মাতৃভাষা থেকে মাতৃভূমির স্বাধীকার অর্জনে সমর্থ হই।
তারপর আনন্দের কথা, আমাদের এই ভাষা দিবসের বিশ্ব অভিষেক ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর থেকে। যে নতুন যুগান্তর আন্তর্জাতিক ভাবে এ দিবসটি স্বীকৃত। শুধু বাঙালির জাতীয় ভাষা দিবস নয়। ইউনেস্কোর (টঘঊঝঈঙ) কল্যাণে সমগ্র বিশ্বে (জাতিসংঘ ভুক্ত ১৯৪টি দেশে) প্রতিবছর ২১শে ফেব্র“য়ারি আর্ন্তজাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে উদযাপিত হচ্ছে। বিশ্বে সমগ্র ভাষার মধ্যে বাংলা ভাষার স্থান চতৃর্থ হলেও বিশ্বের প্রায় ৪ হাজার ভাষার মধ্যে বাংলা ভাষাকে অনন্য মর্যাদায় অভিষিক্ত করা হয়েছে। বাংলাই একমাত্র ভাষা যা ভাষার ভিত্তিতে রাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছে। ভাষা দিবসের এই বিশ্ব অভিষেক, আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়ে শহীদের আত্মত্যাগ সর্বাংগে সার্থক হবে। এই আনন্দ, এই সুখ, এই শান্তি-প্রকাশে অব্যক্ত খুশিতে ভরপুর আমাদের হৃদয় মন এবং উচ্ছ্বসিত আনন্দে উদ্বেল আমরা। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বিশিষ্টতা দান করেছে। এ স্বীকৃতির মধ্য দিয়েই শহীদের আতœা শান্তি লাভ করেছে। বর্তমানে জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবেও বাংলাকে মর্যাদা দেবার দাবি উত্থাপন হয়েছে, আমরা আশাবাদী আমাদের প্রাণের এ দাবি বাস্তবায়িত হবেই। প্রিয়জনহারাদের এই প্রাপ্তি আনন্দের ও গর্বের। তারপরও কথা থেকে যায় অনেক। এ আনন্দ ও শান্তি লাভ করতে গিয়ে দুঃখবোধ জাগে অনেক। কেননা, আমরা মাতৃভাষা ও মাতৃভূমির স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনে পরিপূর্ণভাবে স্বাধীনতার আস্বাদ অনুভব করতে গিয়ে হারিয়ে ফেলেছি আত্মপ্রত্যয়ী মনোভাব। চারিদিকে বিশৃঙ্খলার আঁধার বিরাজ করছে। শহীদ ভাইদের ত্যাগ ও তিতিক্ষার কথাগুলো ভুলে ব্যথাভরা ইতিহাস পেরিয়ে এসে স্বাধীনতার সম্ভ্রম, সম্মান ও ঐশ্বর্যকে ধূলোয় লুটিয়ে ফেলেছি। সন্ত্রাস, কালো টাকা, নারী নির্যাতন, মধ্যযুগীয় বর্বরতা ফতোয়াবাজি, লোভ-লালসা, হিংসা বিদ্বেষ, কলুষিত মনের সংকীর্ণতা, মানবতার অবমাননা, লাঞ্ছনা, অসভ্য উদ্ভট নোংরা উম্মাদনায় গা ভাসিয়ে দিতে একটুকু দ্বিধাগ্রস্থ নয় সজ্ঞানী সত্বাগুলো। সহনশীলতা, সহিঞ্চুতা, প্রজ্ঞা, জ্ঞানের আলোক মুখ থুবড়ে পড়ে থাকে পাপপঙ্কিল আবর্জনায়।
বিশ্বের ইতিহাসে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করে মাতৃভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে আন্দোলন করে বুকের তাজা রক্তে রাজপথ রঞ্জিত করে যে বাংলাকে প্রতিষ্ঠা করেছিলাম, যার সূত্র ধরেই মাতৃভূমির আন্দোলন ও স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুত্থান সেই মাতৃভাষা বাংলা রাষ্ট্রীয়ভাবে কতটুকু প্রতিষ্ঠা লাভ করতে পেরেছে এটাই আজকের জিজ্ঞাসা। এখনো সর্বোচ্চ আদালতের রায় হয় ইংরেজিতে। অফিস, ব্যাংকগুলোতে ইংরেজির ব্যবহার অধিক। আমরা নিজেরা যদি বাংলাদেশে এই মহান আত্মত্যাগের মর্যাদা দিতে না পারি তাহলে জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা বাংলা হলে কী লাভ? আগে আমাদের ঘর ঠিক রাখতে হবে। সর্বত্র বাংলা ভাষার ব্যবহার বাধ্যতামূলক করতে হবে। ফেব্র“য়ারি মাসে সভা সেমিনারে ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বক্তৃতা দিলেই চলবে না, শিকড়কে মজবুত করতে নব প্রজন্মকে শাণিত করতে নীতিমালা করে বাংলার আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের যথার্থ মূল্যায়ন করতে হবে। সভ্যতার নামে আমরা যতই বছর অতিক্রান্ত করছি ততই মাতৃভাষা বাংলাকে অবহেলা করছি। বাঙালি হয়ে নিজেদের সন্তানদের উচ্চবিত্ত আধুনিক সমাজের নাগরিক প্রমাণে ইংলিশ মিডিয়ামে ভর্তি করিয়ে ইংরেজী চর্চায় পারদর্শী করছি। বিদ্যালয়ের প্রথম পাঠদানও ইদানিং বাংলার পরিবর্তে ইংরেজি, গণিত বা অন্যান্য শিক্ষা দিয়ে শুরু। মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ডতো অন্যগতিতে চলছেই। কিন্তু সাধারণ শিক্ষা ব্যবস্থা বাংলাদেশ ও ভারতের বাঙালি অধ্যুষতি অঞ্চল/প্রদেশ গুলোতে ভাষা শহীদদের প্রতি যথাযোগ্য সম্মান ও অনেক ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত মাতৃভাষা বাংলাকে সম্মান জানাতে সর্বক্ষেত্রে বাংলার প্রচলন বাধ্যতামূলক করার জন্য রাষ্ট্রপরিচালকদের কাছে সচেতন বাঙালিদের বিনীত নিবেদন।
মানচিত্রের ব্যবধানে আমরা ভিন্ন ভিন্ন দেশের নাগরিক হলেও বাঙালি জাতি হিসেবে বিশ্বের কাছে এক গনির্বত সন্তান। যাঁরা মাতৃভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে অকাতরে প্রাণ দিয়ে সমগ্র বিশ্বে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করে আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষার স্বীকৃতি অর্জন করেছে জাতিসংঘে দাপ্তরিকভাষা ও বিশ্বের অন্যতম দ্বিতীয় ভাষা হিসাবে স্থান করে নিয়েছে। বাংলাদেশে রাজনৈতিক মতবিরোধ থাকলেও বাংলা ভাষা নিয়ে কোন মতবিরোধ সরাসরি নেই। তবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সুকৌশলে বাংলাকে অসম্মান করার প্রবণতা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। ভারতে বহু ভাষার দেশ। পশ্চিমবাংলা, আসাম, ত্রিপুরা, উড়িষ্যা ও ঝাড়খন্ড তে প্রচুর বাঙালির বসবাস। সাম্প্রতিককালে পশ্চিমবঙ্গেও বাংলা ভাষার প্রতি অমর্যাদা বা বাংলাকে বৃদ্ধাঙ্গুলী দেখিয়ে অন্য ভাষার প্রতি আকৃষ্ঠতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা পর্যায়ে অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে বাংলাকে পাঠদানের প্রতি বিশেষ নজরদারীর জন্য সচেতন বাঙালিরা জোর দাবী জানাই। বাঙালি সন্তানেরা যথার্থ বাঙালি হয়ে গড়ে উঠুক অন্য ভাষার প্রতি সম্মান দান ও দক্ষতা অবশ্যই অর্জন করবে। কিন্তু নিজেদের মাতৃভাষাকে শুদ্ধরূপে বলতে লিখতে পড়তে বাংলার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ জাগ্রত করতে রাষ্ট্রীয় তথা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ভূমিকা অসীম। সেই সাথে আধুনিক সভ্যতার নামে যে সকল পরিবার নিজ সন্তানদের বাংলা বিমুখ করে অন্য ভাষার প্রতি আগ্রহী করে ছোট থেকে গড়ে তোলার অপপ্রয়াস চালাচ্ছেন তাদের প্রতিও অনুরোধ নিজের পিতা মাতার মতো মাতৃভাষার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ জাগ্রত রাখতে সচেষ্ট হোন।
শেষান্তে-সহস্র শহিদী আত্মার মাগফেরাত কামনা করে ভাষার প্রতি অসীম শ্রদ্ধা রেখে আলোকিত দেশ ও সমাজ গড়ে তোলার জন্য ভাষার সঠিক মূল্যায়নের শপথ নিতে হবে। শুভ হোক আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, নতুন শতাব্দীর চক্রবাকে মূকবেদনায় যেন বধির হতে না হয় আমাদের। আসুন আমরা শপথ নেই আমাদের পূর্ব পুরুষ/ নারী যে সকল বাঙালিরা মাতৃভাষা বাংলা অর্জনে আত্মবলিদান দিয়েছেন তাঁদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধান্তে দল মত জাতি ধর্ম রাষ্ট্র বিভাজন সবকিছু ভুলে গিয়ে মাতৃভাষা বাংলার প্রতি শ্রদ্ধাবান হয়ে আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মকে সঠিক বাঙালি হিসেবে গড়ে তুলতে যতœবান হই। ‘বাংলা আমার মাতৃভাষা বাঙালিত্ব আমাদের প্রাণ, বাঙালি হিসেবে গর্বিত মোরা বিশ্বে পরিত্রাণ।’ সকল অশুভ শক্তি কুট কৌশলকে মোকাবেলা করে আমরা আজ সম্মিলিতভাবে স্বপ্নের শাশ্বত সুন্দর সোনার বাংলা গড়ে তুলবো। যেখানে থাকবেনা অন্যায়, অমানবিকতা, হিংসা, ত্রাসের রাজত্ব এবং নোংড়া মনের অভিশাপ। দেশ ও দশের জন্য যা আনবে শান্তি ও সমৃদ্ধি। মহান ভাষা আন্দোলনের ৭১তম বর্ষে মহান স্রষ্টা আমাদের সে শক্তি দান করুন।
লেখক পরিচিতিঃ কবি, গল্পকার, উপন্যাসিক, নাট্যকার ও প্রাবন্ধিক, সদস্য, বাংলা একাডেমি, ঢাকা। প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, বাংলাদেশ কবিতা সংসদ, পাবনা।

—–

Please follow and like us:

Leave a Reply

Your email address will not be published.